রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ চালু হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর হল। কিন্তু এখনও শুরু হয়নি প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব একাডেমিক ভবন তৈরির কাজ। ক্লাস চলছে রাঙ্গামাটি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের অব্যবহৃত সিসিইউ ভবনের কয়েকটি কক্ষে।
নেই বায়োকেমিস্ট্রি, ফরেনসিক মেডিসিনসহ বেসিক বিষয়গুলোর শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থাও নেই মেডিকেল কলেজটিতে। এমনকি কলেজটির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বেরিয়ে যাওয়ার সময় হলেও তাদের ইন্টার্ন করা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। সোমবার (২৩ এপ্রিল) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাশেদ রাব্বি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, মিলনায়তন, পাঠাগার, আধুনিক ল্যাব ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে একই কক্ষে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের বসতে হয়।
সরেজমিনে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজে গিয়ে জানা গেছে, পাঁচ বছর পরও ইন্টার্নশিপের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে একটি ব্যাচের ইন্টার্ন করার সময় হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিয়মানুসারে, ইন্টার্নি করার জন্য মেডিকেল কলেজের অন্তর্গত একটি ২৫০ শয্যাসম্পন্ন হাসপাতাল থাকতে হবে।
কিন্তু এখানে আছে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল। যদিও ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিকে ভবন সংস্কার ও সম্প্রসারণ ছাড়াই ১০০ শয্যায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। আবার ইন্টার্ন করা না হলে এই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসক হিসেবে পূর্ণতা অর্জন করতে পারবেন না। ফলে তাদের পড়তে হবে সেশনজটে।
মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা জানান, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকে ইন্টার্ন শুরু হওয়ার কথা এই মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীত করার প্রস্তাব থাকলেও তার কাজ এখনও শুরু হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন কাজ শুরু হলেও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীদের ইন্টার্ন করতে অন্য মেডিকেল কলেজের দ্বারস্থ হতে হবে। সেক্ষেত্রেও রয়েছে নানা জটিলতা।
কলেজটির শিক্ষকরা জানান, এখানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বেসিক বিষয়গুলোর পড়ানোর কোনো শিক্ষক নেই। বিশেষ করে কয়েকটি বেসিক বিষয় প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষকদের দিয়ে পড়ানো সম্ভব হলেও বায়োকেমিস্ট্রি ও ফরেনসিক পড়ানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ৪৮ শিক্ষক থাকলেও তাদের দিয়ে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা চালানো প্রায় অসম্ভব। জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সহযোগিতায় কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এছাড়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসনের সুবিধা নেই। হাসপাতালের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পরিত্যক্ত কয়েকটি আবাসনে আপাতত শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে শিক্ষকদের জন্য এখনও কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. টিপু সুলতান বলেন, অস্থায়ী ভবনটিতে বর্তমানে পাঁচটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নরত আছে। কিন্তু স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় সংকট দিন দিন বাড়ছে। কখনও কখনও বারান্দায় ক্লাস নিতে হয়।
একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যাও প্রকট। তিনি বলেন, ইতোপূর্বে কলেজের উন্নয়নে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও কাজ শুরু হয়নি। এমনকি স্থাপত্য অধিদপ্তর নকশা পর্যন্ত দিতে পারছে না। এ কারণে টেন্ডার আহ্বান করতে পারছে না পিডব্লিউডি। ফলে পিছিয়ে যাচ্ছে মেডিকেল কলেজের ভবন নির্মাণের কাজ।
শিক্ষার্থীদের ইন্টার্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের এমবিবিএস চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপরই তাদের ইন্টার্নের ব্যবস্থা করতে হবে। এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
তিনি জানান, একটি মেডিকেল কলেজের প্রতিটি শিক্ষার্থীর অনুকূলে পাঁচটি করে হাসপাতালের শয্যা থাকার নিয়ম। যেহেতু মেডিকেল কলেজটিতে বছরে ৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, সে অনুসারে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি হাসপাতাল থাকতে হবে। না হলে ইন্টার্নি করা যাবে না। তাছাড়া মেডিকেল কলেজ স্থাপনের আগেই এই হাসপাতাল স্থাপন করার কথা। আমাদেরকে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল তৈরি হওয়ার খবর জানানো হলেও আজ পর্যন্ত তার কাজ শুরু হয়নি।
এদিকে, হাসপাতালটিতে ৩১ চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে চিকিৎসক আছেন ১৭ জন। অভাব রয়েছে নার্সেরও। গড়ে প্রতিদিন হাসপাতালে ২০৫-৩০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় ব্যবস্থাপনাতেও নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, রাঙ্গামাটি শহরের সবচেয়ে দুর্বল বা জরাজীর্ণ ভবন হচ্ছে এই রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল ভবনটি।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভবনটি তৈরি করা হয়। এছাড়া হাসপাতালজুড়ে নোংরা পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ বন্ধ থাকায় হাসপাতালটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কর্মীদের অভাব রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিদিন গড়ে ১১০ রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি থাকে, যাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষের।
এসব বিষয়ে শুক্রবার হাসপাতাল চত্বরে কথা হয় রাঙ্গামাটি জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. নিহার রঞ্জন নন্দীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজের সঙ্গে হাসপাতাল জড়িত। তাই কলেজের কাজ শুরু না হলে হাসপাতালের উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আপাতত চিকিৎসক ও নার্স সংকট তেমন না থাকলেও সরকারিভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। যে কারণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কর্মীদের ব্যাপক সংকট রয়েছে। সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহসান হাবীব বলেন, আমি এই পদে নতুন এসেছি। তাই এ বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে অবগত নই। এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ জানাবেন বলে তিনি জানান।