একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির রসায়ন পাঠ্যবই ও কিছু কথা - দৈনিকশিক্ষা

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির রসায়ন পাঠ্যবই ও কিছু কথা

মো. আবু হানিফ ভূইয়া |

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে NCTB কর্তৃক রসায়ন পাঠ্যসূচিতে ‘Green Chemistry','Nanoparticles’, এবং ‘Environmental Chemistry’-এর মতো সমকালীন বিশ্বে আলোচিত topics সংযোজনসহ তড়িৎ রসায়নে ‘লিথিয়াম ব্যাটারি ও বিভিন্ন প্রকার ফুয়েল সেল গঠন ও ব্যবহার’ ‘বর্ণালীমিতির তত্ত্ব ও প্রয়োগ’, ‘ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার’, ‘ঘনমাত্রায় ppm’, ‘কর্মমূখী রসায়ন’ ও ‘অর্থনৈতিক রসায়ন’ ইত্যাদি তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ অধ্যায় অন্তর্ভুক্তি গতানুগতিক ধারার পরিবর্তে বৈশ্বিক সমসাময়িক পাঠ্যবই প্রণীত হয়েছে। এজন্য NCTB কে ধন্যবাদ।

কিন্তু NCTB কর্তৃক অনুমোদিত রসায়ন পাঠ্যবই-এর সংখ্যা এবং আলোচিত topic গুলোর ক্রমবিন্যাস, ব্যাখ্যা ও ব্যাপ্তিতে যথেষ্ট অসামঞ্জস্য রয়েছে। যেমন রসায়ন বিষয়ের প্রত্যেক পত্রে অনুমোদিত বইয়ের সংখ্যা ১৪টিরও বেশি এবং প্রত্যেক প্রকাশনার বইয়ে লেখকরা ১টি নির্দিষ্ট topic-এর ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করায় একজন শিক্ষার্থীকে ১৪টি বই-ই ক্রয় ও অধ্যয়ন করতে হচ্ছে, যা দুঃসাধ্য।

১৪টি বইয়ের প্রতিটি topic-এর আয়তন ব্যাপক; যা একজন উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীর ওপর ভয়ানক চাপ ফেলছে। উপরন্তু topic গুলোর ক্রমবিন্যাসে কোনো ধারাবাহিকতা না থাকায় একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে একটি অধ্যায় অধ্যয়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাছাড়া topic শেষে ‘চিন্তা করে উত্তর দাও’, ‘নিজে কর’, ‘শিক্ষার্থীর কাজ’ ইত্যাদির ক্ষেত্রে অসম্ভব বাড়াবাড়ি লক্ষ করা যায়।

বিষয়টি একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করছি। রসায়নের ২য় পত্রে জৈব রসায়ন অধ্যায়ের ক্ষেত্রে যেখানে রসায়নের একটি বিশাল অংশকে ছোট্ট একটি অধ্যায়ে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে লেখকরা যে যার ইচ্ছেমতো আলোচনা করেছেন। জৈব বিক্রিয়াসমূহের ক্ষেত্রে যেভাবে একটি বিক্রিয়া দিয়ে প্রায় সব জৈব যৌগ টেনে নিয়ে আলোচিত হয়েছে, তা রসায়ন তথা বিজ্ঞানের নবীন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

যেমন যুত বিক্রিয়া অংশে অ্যালকিন, অ্যালকাইন, বেনজিন, অ্যালডিহাইড ও কিটোনের যুত বিক্রিয়া এবং প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে অ্যারোমেটিক যৌগের (বেনজিন) ইলেকট্রোফিলিক প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া, অ্যালকেনের হ্যালোজিনেশন (ফ্রি রেডিক্যাল ম্যাকানিজম), অ্যালকাইনের এসিড বিক্রিয়া, অ্যালকাইল ও অ্যারাইল হ্যালাইডের নিউক্লিওফিলিক প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া (SN1I SN2) আলোচিত হয়েছে। এভাবেই প্রত্যেকটি জৈব বিক্রিয়া আলোচিত হয়েছে, যা শুধু অর্নাস পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব। এজন্যই হয়তো শিক্ষক তথা শিক্ষার্থীরা পুরাতন কারিকুলামের বইকে অনুসরণ করে থাকে।

এরকম ১ম ও ২য় পত্র বইয়ের প্রত্যেকটি topic-এর ক্ষেত্রে একই চিত্র পাওয়া যায়। তাহলে আমাদের শিক্ষার্থী তথা শিক্ষকদেরকে অনুমোদিত সব কয়টি বই-ই ক্রয় করতে হবে এবং অধ্যয়ন করতে হবে। এমনকি NTCB-এর কোনো তদারকি না থাকায় প্রায় প্রত্যেকটি প্রকাশনা তাদের নিজ নিজ বইয়ের আয়তন ক্রমশ বাড়িয়ে এ অসামঞ্জস্যতা আরও প্রকট করে তুলেছেন।

যেমন কোনো কোনো বইয়ের আয়তন ৩০০ থেকে ৬০০ বা ৬৫০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে; আবার কোনো প্রকাশনীর বইয়ের আয়তন লুকোচুরি করে বাড়িয়ে (176 bs নং 176, 176-1, 176-11, 176-111, 176-IV ও 176-V লিখে ৬টি পৃষ্ঠায় পরিণত করে) নিচ্ছেন। ফলে একজন শিক্ষার্থীকে কতটুকু পড়তে হবে এবং একজন শিক্ষককে কতটুকু পড়াতে হবে- এ বিষয়ে NTCB কর্তৃক অনুমোদিত Text বই কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে পারছে না।

রসায়ন ১ম ও ২য় পত্র বইয়ে topic গুলোর ক্রম বিন্যাসে রয়েছে বেশ অসংলগ্নতা। যেমন রসায়ন ১ম পত্রের ২য় অধ্যায় (গুণগত রসায়ন)-এ ‘দ্রাব্যতা ও দ্রাব্যতা গুণফল’ topic অধ্যয়ন করতে গেলে ‘দ্রবণের ঘনমাত্রা’ এবং ‘দ্রবণ লঘুকরণ’ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক; সেখানে ‘দ্রবণের ঘনমাত্রা’এবং ‘দ্রবণ লঘুকরণ’ বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে রসায়ন ২য় পত্র বইয়ের ৩য় অধ্যায়ে (পরিমাণগত রসায়ন) যা আদৌ কাম্য নয়। সবচেয়ে আপত্তিকর হল- রসায়ন ১ম পত্রের ৩য় অধ্যায় (মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ও রাসায়নিক বন্ধন)-এর শুরুতেই গ্রুপ/ ব্লকভিত্তিক মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলী (গলনাংক, স্ফূটনাংক, চুম্বক ধর্ম, বিভিন্ন ধরনের যৌগ গঠন, যৌগসমূহের দ্রাব্যতা, তাপসহতা, জটিল আয়ন গঠন, বর্ণযুক্ত আয়ন ইত্যাদি) আলোচিত হয়েছে; অথচ এসব ধর্মাবলী অধ্যয়ন করার পূর্বে একজন শিক্ষার্থীর মৌলসমূহের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম (পারমাণবিক আকার, আয়নীকরণ বিভব, ইলেকট্রন আসক্তি, ইলেকট্রোনেগেটিভিটি ইত্যাদি) ও রাসায়নিক বন্ধন (আয়নিক বন্ধন, সমযোজী বন্ধন, সন্নিবেশ বন্ধন, অষ্টক সংকোচন, অষ্টক সম্প্রসারণ, সংকরণ,অণুর আকৃতি, ভ্যান্ডার ওয়ালস বল, হাইড্রোজেন বন্ধন, ধাতব বন্ধন, পোলারিটি, পোলারায়ন ও তার সম্পর্কিত ফাযানের নীতি ইত্যাদি) বিষয়ক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। অতএব এ অধ্যায়ের topic-এর বিন্যাস নিম্নরূপ-

‘প্রথমে মৌলসমূহের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম, তারপর রাসায়নিক বন্ধন এবং সবশেষে মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মাবলী’ হওয়া উচিত বলে মনে করি। এতে শিক্ষার্থী তথা শিক্ষকের কাছে অধ্যায়টি বেশ আকর্ষণীয় হতো।

একইভাবে রসায়ন ১ম পত্রের ৪র্থ অধ্যায় (রাসায়নিক পরিবর্তন)-এ বিক্রিয়ার হার ও সাম্যধ্রবকের ওপর তাপমাত্রার প্রভাব সম্পর্কিত যথাক্রমে আরহেনিয়াস সমীকরণ ও ভ্যান্টহফ সমীকরণ অধ্যয়ন করার পূর্বে সার্বজনীন গ্যাস ধ্রবক, জ সম্বন্ধে জানা অবশ্যই দরকার; অথচ এ জ রসায়ন ২য় পত্র বইয়ের ১ম অধ্যায়ে (পরিবেশ রসায়ন) আলোচিত হয়েছে। সুতরাং উপযুক্ত ধারাবাহিক topic বিন্যাসের অভাবে শিক্ষার্থীরা রসায়ন পাঠ্যবই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং এদের কাছে রসায়ন একটি দুর্ভেদ্য ও জটিল বিষয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

অতএব একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর রসায়ন পাঠক্রমে অধ্যায় বা topic বিন্যাস নিম্নরূপ-

‘ল্যাবরেটরি নিরাপদ ব্যবহার’, ‘পরিবেশ রসায়ন’, ‘পারমাণবিক গঠন, তড়িৎ চুম্বকীয় বর্ণালী ও এর প্রয়োগ’, ‘পর্যায়বৃত্ত ধর্ম ও রাসায়নিক বন্ধন (মৌলের শ্রেণীবিভাগ, পর্যায়বৃত্ত ধর্ম, রাসায়নিক বন্ধন, গ্রুপ/ব্লকভিত্তিক মৌলসমূহের সাধারণ ধর্ম)’, ‘পরিমাণগত রসায়ন’, ‘কর্মমুখী রসায়ন’, ‘গুণগত রসায়ন (দ্রাব্যতা, দ্রাব্যতা গুণফল, ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন সনাক্তকরণ, বিভিন্ন প্রকার পাতন প্রক্রিয়া, দ্রাবক নিষ্কাশন ইত্যাদি)’, ‘রাসায়নিক পরিবর্তন’, ‘জৈব রসায়ন’, ‘তড়িৎ রসায়ন’ ও ‘অর্থনৈতিক রসায়ন’ হলে সার্থক ও কার্যকর পাঠ্যবই হিসেবে পরিগণিত হবে বলে মনে করি।

আরেকটি কথা- পাঠ্যবইয়ে ছাপার ভুল এবং গাণিতিক সমস্যায় ভুল প্রশ্ন ও ভুল উত্তর প্রায়ই দেখা যায়; যা NCTB এবং প্রকাশনা তথা লেখকদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

পাঠ্যবই হবে নির্ভুল এবং সব শিক্ষার্থীর কাছে বোধগম্য। নচেৎ শিক্ষার্থীরা confidence হারিয়ে ফেলে। রসায়নের মতো একটি জটিল বিষয়ের পাঠ্যবইয়ে এরকম ত্রুটি-বিচ্যুতি কোনোক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। সুতরাং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের রসায়নে কতটুকু জ্ঞান রাখা দরকার, তা নির্ধারণ করে প্রতিটি topic-এর দৈর্ঘ্য সুনির্দিষ্ট করে topic গুলোর ক্রমবিন্যাস বা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে প্রতি পত্রে ২-৩টি বই অনুমোদন করে এবং সে ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করলে এ দুই বছরে বেশি আউটপুট পাওয়া যাবে।

লেখক: উপাধ্যক্ষ, চান্দিনা রেদোয়ান আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014910936355591