‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি;
সত্যিই তাই। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আর কোন জাতিকে রক্ত দিতে হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ফেব্রুয়ারির একুশ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। একুশের শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতি নিজেকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে প্রাপ্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের মূলে রয়েছে একুশের চেতনা। একুশ মানে মাথা নত না করে শির উন্নত করে এগিয়ে যাওয়া।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল এদেশের শিক্ষাসহ মৌলিক সকল অধিকার ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝে নিশ্চিত করা। একুশ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল এদেশের মানুষের জন্য সোনার বাংলা গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যেখানে শুধু অভাব আর অভাব তার মাঝেও উপলব্ধি করেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে দুঃস্বপ্ন। সেদিন রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। প্রায় দেড় লক্ষ শিক্ষক সরকারি কর্মচারির মর্যাদা পান। এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ শুধু তার মতো মহাপুরুষের পক্ষে সম্ভব ছিল।
সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগের অভাব ও তখনকার দিনে পোষ্ট অফিসের পিয়নদের মাধ্যমে অসহায় প্রাথমিক শিক্ষকদের সামান্য বেতন প্রাপ্তি তার নজর কেড়ে নেয়। সাধারণ মানুষ ও প্রাথমিক শিক্ষকদের সেই প্রিয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু ১৫ই আগষ্ট শাহাদাৎ বরণের পর প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর ১৯৮০-৮১ সালে বেসরকারিকরণের ঝড় নেমে আসে। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আন্দোলনে শিক্ষকদের বেসরকারিকরণের এ দূর্যোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিনামূল্যে বইসহ অসংখ্য অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে প্রশাসনের কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের কর্মকান্ড। তারা একুশের অহঙ্কারকে উজ্জীবিত করার পরিবর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তোষণ প্রয়োগে ব্যস্ত। তৃণমূলের শিক্ষা অধিকার খর্ব করে সহকারি শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক, সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার পর্যায়ক্রমে সবোর্চ্চ পর্যন্ত এই তৈলমর্দন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। শিক্ষার মধ্য দিয়ে আগামি প্রজম্ম সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠুক সংশ্লিষ্ট অনেকের মাঝে এই ভাবনা দৃশ্যমান নয়। তেলে তেলে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারই যেন কাম্য। সবার প্রত্যাশা যেন একই সুরে গাথা। অভিভাবক, শিক্ষকসহ খোদ মন্ত্রীর কর্মকান্ড প্রমাণ করে শিক্ষার একমাত্র মানদ- জিপিএ ৫। এই অভীষ্ট গ্রেড পয়েন্ট না পেলে সবার ঠুনকো মানসম্মান যেন গুড়িয়ে যাবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় ইদানিং একটি স্কুলে গিয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ফোর বানান বলতে বললে তারা তা পারেনি। “প্রাথমিকের শিশুরা কী শিখছে?” শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হয়।
তোষামোদির আবর্তে পরে প্রাথমিক শিক্ষকেরা যে তাদের শিক্ষাদানের পবিত্র দায়িত্ব ভুলতে বসেছেন, এটি তারই একটি সামান্য নমুনা। প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও পথভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। যার অন্যতম চ্যালেঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান সময়সূচি। এই সময়সূচি বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীশূন্য করে ফেলছে। উপবৃত্তি টিফিন সহায়ক হলেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এসব ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়মুখী করতে সক্ষম হচ্ছে না। খোদ রাজধানী ঢাকায় পরিদর্শন করে দেখা যায় এক শিফটের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির করুণ দৃশ্য। বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থী যখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাস দিয়ে ছুটির সময় আসা যাওয়া করে তখন জননন্দিত কন্ঠশিল্পী মমতাজের গানের কলির যথার্থতা প্রমাণ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের “বুকটা ফাইটা যায়”।
সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত শিশু শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় নামক হাজতখানায় থেকে শুধুমাত্র বিস্কুট জাতীয় হালকা খাবার বা উপবৃত্তির ১০০ টাকা প্রতি মাসে পায়। এই সামান্য প্রাপ্তি শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের সন্তুষ্ট করার জন্য পুরোপুরি সহায়ক নয়। এই সময়সূচি শিশু নির্যাতনের সমতুল্য।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ প্রাথমিকে যেন ‘‘জম্ম থেকে জ¦লছি” প্রবাদের মতো। অনেকটা যেন নদীর এ কুল গড়ে ও কুল ভাঙ্গে অবস্থার মতো। অহরহ অবসর গ্রহণ, অন্যত্র চলে যাওয়া এবং অন্যান্য কারণে বছর না ঘুরতেই বিপুল পরিমাণে শূণ্য্যপদ সৃষ্টি হয়। নিয়মিত নতুন শিক্ষক নিয়োগ না করে বছরের পর বছর শিক্ষকশূণ্য রেখে প্রাথমিকের শিক্ষকদের অনেকেটা জোড়াতালি এবং লম্প-ঝম্প দিয়ে দৌড়ের ওপর ক্লাস নিতে হয়। শিক্ষার্থীদের যথাযথ সময় না দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষকের কোন জবাবদিহি নেই। কর্তাব্যক্তিদের সাথে সংযোগের সামান্য ক্রটি হলে কোন কোন ক্ষেত্রে মহাবিপদ হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে তেলের ব্যবহারই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষাদান বহির্ভূত কাজের ব্যাপকতায় শিক্ষকের ইচ্ছা থাকলেও ঠিকমত পড়াতে পারেন না। ফলে আগামি প্রজম্ম বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার অধিকার থেকে। প্রশাসনসহ সর্বস্তরের জনগণ সমস্বরে নিন্দা জানায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। শিক্ষা ব্যবস্থার বাণিজ্যকরণে অভিভাবক ছুটছে নোট, গাইড, কোচিং সেন্টারের দিকে। সংশ্লিষ্টরা কানে সীসা লাগিয়ে তেল প্রয়োগ করে স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধি করে যাচ্ছেন। ৩৭ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা অব্যবস্থাপনা ও সংকট চলছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর আজও কোথাও কোথাও খোলা আকাশের নিচে পাঠদান করার চিত্র দেখা যাচ্ছে। খোদ রাজধানীতে অসংখ্য বিদ্যালয় দখলমুক্ত হচ্ছে না । সারাদেশে ১ ও ২ জন শিক্ষক দ্বারা পাঠদান চলছে অসংখ্য বিদ্যালয়ে। এক-দুই কক্ষ বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কম নয়। প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারি। শিক্ষার্থীর শিক্ষা দান ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জবাবদিহি অনেকটা শূন্যের কোঠায়। বিধায় কর্তাব্যক্তিরা তাদের অনেকটা নিজস্ব কর্মচারি হিসেবে ভেবে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রবণতা শিক্ষার্থীদের পাঠদানের চেয়ে কর্মকর্তাদের ডাকে সময়ক্ষেপণ না করে হাজির হওয়ার দিকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এককথায় প্রাথমিক শিক্ষা আজ শিক্ষার্থী নির্ভর না হয়ে কর্মকর্তামুখী। এর থেকে বেরিয়ে আসা আজ অতীব জরুরী।
বিগত ‘বিপন্ন শিশু’ নিবন্ধে আমি প্রাথমিক শিক্ষায় বিশাল জনগোষ্ঠী থাকার পরও ক্যাডার সার্ভিস নেই লিখেছিলাম। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ লেখাকে ভুল আখ্যায়িত করে বললেন ‘ রাজধানীতে থানা শিক্ষা অফিসার ক্যাডার আছে। শুধু সারাক্ষণ লেখালেখি কর ক্যাডার নেই।’ দুজনের তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম ক্যাডার আছে ঠিক, তবে তা হলো ভুয়া পরিচয়দানকারী ক্যাডার। সরকারি কর্মচারির চাকুরি যোগদানের পর তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড বিলুপ্ত হয়। কিন্তুুু রাজনৈতিক দলের ক্যাডার পরিচয় দিয়ে ঘুষ দুর্নীতি, সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সরকারের সর্বনাশ ডেকে আনছে। প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্নীতিবাজ শিক্ষক, কর্মকর্তা যেই হোক তাকে খাঁচায় বন্দি করে শিক্ষাবান্ধব সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে মেধাবী ও অভিজ্ঞদের এই পেশায় ধরে রাখতে প্রাথমিক ক্যাডার সৃষ্টির বিকল্প নেই। গ্রেডমুখী পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করে জ্ঞানমুখী শিক্ষা পদ্ধতির বাস্তবায়ন আজ জরুরী।
পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ব্যাধি র্নিমূল করতে হবে। সকলে এক সুরে গালিগালাজ করছে। যত দোষ নন্দ ঘোষ শিক্ষকদের। সব দোষই যে শিক্ষকদের তা বলা যথার্থ হবে না। শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ওপর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেও যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু একা শিক্ষকদের নয়, শিক্ষার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট সকলের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই সময়ের প্রত্যাশা। সর্বস্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত না করে শুধু শিক্ষকদের অপবাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে রূখে দাড়াতে হবে। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীই বাংলাভাষার যথাযথ চর্চা করছে না। তারা বাংলা বানান লিখতে ভুল করছে, শুদ্ধরূপে বাংলা উচ্চারণ করতে পারছে না। এটি কি একুশের চেতনা বিরোধী নয়? নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষার যথাযথ চর্চা করবে, স্বাধীন বাংলাদেশে এটিই একুশের প্রত্যাশা ছিল। শিক্ষার এ বেহাল অবস্থা দেখে একুশের চেতনা আজ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। এ সকল অব্যবস্থা দূর করার মাধ্যমে একুশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক এটাই আজকের প্রত্যাশা।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা