এতিমদের নামে সরকারি বরাদ্দ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে চলেছে নড়াইলজুড়ে। বছরের পর বছর এতিমের নামে সরকারি টাকা লুটে খাওয়া এতিমখানার সংখ্যা কম নয়। এবার সন্ধান পাওয়া গেছে এমন এতিমখানার, যেটির সভাপতি খোদ জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসককে পুঁজি করে বছরের পর বছর ধরে লুটপাট চললেও তিনি যে ওই এতিমখানার সভাপতি, তা জেলা প্রশাসকই জানেন না বলে দাবি করেছেন। সোমবার (২৬ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে নড়াইল সদরের চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত ‘সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং’ জেলার পুরনো এতিমখানা। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বেসরকারি সংস্থা কারিতাসের সহায়তাপ্রাপ্ত এতিমখানায় ১৯১৫-১৬ অর্থবছরে জেলা পরিষদ থেকেও অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে এতিমখানাটি সমাজসেবার মাধ্যমে সরকারি অনুদান পায়।
কয়েক দফা সরেজমিনে গেলে এতিমখানাটির নানা অব্যবস্থা চোখে পড়েছে এ প্রতিনিধির। বেশির ভাগ সময়ে এতিমখানাটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ এতিমখানায় ১১৪ জন এতিমের নামে মাসে এক লাখ ১৪ হাজার টাকা আর বছরে ১৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। অথচ এখানে চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী থাকলেও তারা নিজেদের অর্থে থাকে-খায় বলে জানা গেছে।
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, পাশের মাদরাসার কিছু ছাত্র রোজার সময় এ লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে নামাজ পড়ে, নিজেদের টাকায় খায়, আবার বাড়িতে চলে যায়।
এতিমখানা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য মতে, এ এতিমখানাটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি খোদ জেলা প্রশাসক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এতিমখানাসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়। সে সময় বিভিন্ন মাদরাসা থেকে ছেলে-মেয়েদের এতিম সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়। গত ৫ আগস্ট যথারীতি জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভোজ দিয়ে এতিম দেখানো হয়েছে।
একই ইউনিয়নে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত জেলার সবচেয়ে বড় বালিকা এতিমখানা ‘আজিজুর রহমান ভূইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানা’। এ এতিমখানার ১২৭ জন বালিকা এতিমের জন্য বার্ষিক বরাদ্দ ১৫ লাখ ২৪ হাজার। এ এতিমখানার অবস্থাও প্রায় একই রকম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন এতিম জানায়, সুপারের বাড়িতে মেহমানদারি, পাট বাছানো, জমির ফসল উঠলে গৃহস্থালির কাজ করানো হয় তাদের দিয়ে।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সমাজসেবার তত্ত্বাবধানে তিন উপজেলার মোট এতিমখানার সংখ্যা ৪৩টি। ছোট-বড় এসব এতিমখানায় মোট এক হাজার ২৬৪ জন এতিমের জন্য মাসে বরাদ্দ দেয়া হয় ১২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, বার্ষিক দেড় কোটি টাকা। শর্ত অনুযায়ী, প্রতিটি এতিমখানা নিজস্ব অর্থে যে কয়েকজন এতিম পালন করে এর দ্বিগুণ এতিম থাকলেই শুধু অর্ধেকের জন্য অনুদান পাবে।
সুপার রাকিবুল বলেন, ‘ভাই যেসব অনিয়ম আছে সব ঠিক করা হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই। আপনি এরপর দেখতে এলে সব ঠিকঠাক দেখতে পাবেন।’
সুপার কাজী আব্দুল কাদের বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আমাদের এতিমখানা চলছে।’ তবে শিশুদের বাড়িতে কাজ করানোর বিষয় তিনি এড়িয়ে যান।
চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ভূইয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে এড়িয়ে গিয়ে দেখা করতে বলেন। পরে কিছু অনিয়ম স্বীকার করে বলেন, ‘এগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে। এতিম না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দুই ভাই একসঙ্গে বসলে সব ঠিক করা যাবে।’
নড়াইলের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি নির্দেশনা দিয়েছি ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ড পেতে গেলে প্রকৃতপক্ষে যে কয়জন এতিম আছে, তাদের হিসাব করেই দিতে হবে।’