এদিন ও সেদিনের 'পড়াশোনা' - দৈনিকশিক্ষা

এদিন ও সেদিনের 'পড়াশোনা'

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

'ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ'-প্রবাদটি আজ  নির্বাসিত প্রায় । ইদানিং স্কুল-কলেজ এমনকি ভার্সিটির অনেক শিক্ষার্থী ও অধ্যয়ন ছাত্র জীবনের প্রধান তপস্যা - তা বিশ্বেষ করে বলে মনে হয় না । জীবনের লক্ষ্য তারা ক'জনে স্থির করে থাকে?  লক্ষ্যহীন জীবন মাঝিহীন নৌকার মতো-এ  ভাবনা তাদের নেই । ইদানিং রাজনীতির নামে ‘তাফালিং’  আর টাচ্ মোবাইল হাতে আড্ডা ইয়ার্কি মারা যেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর প্রধান তপস্যা হয়ে  দাঁড়িয়েছে । পাঠ্য পুস্তকের সাথে  সখ্যতা নেই । বই পড়া  তাদের কাছে বাড়তি ঝামেলা । কেন যে পাঠ্য পুস্তক শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে পারে না তা ভেবে দেখা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে । 

আমরা ছোটবেলা বইয়ের সাথে লেগে থেকেছি । নতুন বই হাতে পেলে এক নাগাড়ে পড়ে ফেলতাম। বইয়ের সাথে ভিন্ন এক সখ্যতা ছিল । পরীক্ষা এলে খাওয়া- পরা, ঘুম-নিদ্রা বাদ দিয়ে কেবল পড়াশোনা করেছি । পরীক্ষার ভয়ে তটস্থ থেকেছি। আজকাল অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগের রাতে ও পড়াশোনার গরজ বোধ করেনা । রাত বারটা-একটা পর্যন্ত মোবাইল ফোনে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আলাপ কিংবা চ্যাটিং নিয়ে ব্যস্ত  থাকে। ইন্টারনেটে লেগে থাকে। আমাদের সময় 'পরীক্ষার পুর্ব রাত্রি' নামে ব্যাকরণ বইয়ে একটা ইম্পর্টেন্ট রচনা ছিল। রচনাটিতে পরীক্ষার পূর্ব রাতের বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল । দু'-এক বছর পর পর এটি পরীক্ষায় আসত । 

আজকাল রচনাটির গুরুত্ব ও বাস্তবতা আর নেই। আজ 'পরীক্ষার পুর্ব রাত্রি' রচনা লিখতে গেলে যা লেখা হবে তা পরীক্ষার প্রস্তুতির সাথে সঙ্গতিপুর্ণ হবার কথা নয় । আমাদের অভিভাবকদের কথা কী আর বলব? সিক্স-সেভেনে পড়ুয়া ছেলে মেয়ের হাতে মোবাইল তুলে দিতে তাদের এতটুকু বাধে না । মোবাইল ফোন নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের একেবারে বিনাশ করে ফেলছে-সে আমাদের বোধগম্য হয় না কেন ?  বাবা-মা কি যেন এক আদরের বশবর্তী হয়ে সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দেন । সে আবার স্মার্ট ফোন বা আই-ফোন । এ সব ফোনের ইউটিউব বা গুগলে একবার ঢুকলে নষ্ট হবার জন্য আর কিছুর দরকার পড়ে না । পড়াশোনায় নগদ আনন্দ নেই । ইউটিউব ও গুগলে নগদ নষ্ট আনন্দ মেলে । আনন্দে আনন্দে নষ্ট হবার এ তো উত্তম জায়গা । ইউটিউব কিংবা গুগল থেকে আজে বাজে জিনিসগুলো মুছে ফেলতে পারলে আমাদের প্রজন্মকে হয়তো বা বাঁচানো যেত । এ দায় আমাদের রাষ্ট্র যদি না নেয় তবে কে নেবে ?  আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে না পারলে দেশটা বাঁচবে কী করে ? মোবাইল কোম্পানিগুলোকে যা ইচ্ছে তা করতে দেয়া ঠিক নয় । কলরেট যার যার ইচ্ছে মত। নতুন প্রজন্ম ও আমাদের শিক্ষার্থীদের নষ্ট করার যত সব অফার তারা বাজারে ছাড়ে । ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সময়টাতে তাদের ফ্রি টক টাইম থাকে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এ সুযোগটি সহজে গ্রহণ করে। লাটে ওঠে ওঠে তাদের পড়াশোনা । 

আমাদের শিক্ষকদের আমরা কতই না শ্রদ্ধা করতাম। আজও করি । আমরা বিশ্বাস করতাম, 'শ্রদ্ধাবান লভে জ্ঞান অন্যে কভু নয়' । আজকালের অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সামান্যই তোয়াক্কা করে। আমরা তো ভয়ে স্যারদের সামনে দাঁড়াতে পারতাম না। আজকাল অনেক স্যার ইজ্জতের ডরে  কোন ছাত্রকে কিছু বলতে সাহস পান না । কিছু বলতে গেলে পাছে ঝামেলা পেয়ে বসে। প্রাইমারি স্কুলে পর্যন্ত একজন স্যার কোন শিক্ষার্থীকে বড় করে একটা ধমক  দিতে পারেন না । তাহলে আজকালের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের মাথায় চড়বে না তো চড়বে কোথায়?  কোন গরজে কিংবা কার ভয়ে পড়াশুনা করবে? শিক্ষককে এক-আধটু ডর-ভয় না থাকলে পড়াশুনা হয় কী করে ?
আমাদের সময় শিক্ষকদের ভয়ে পড়াশুনা না শিখে উপায় ছিল না। এখন শিক্ষক সামান্য শাস্তি দিলে তাকে থানা-পুলিশে দৌড়াতে হবে । জেল খাটতে হবে । চাকরিও খোয়াতে হবে। অনেকের হয়েছেও তা-ই। 

পরীক্ষা পাসের জন্য আজকাল বাড়তি প্রস্তুতি বা পড়াশোনার দরকার পড়ে না। গত কয়েক বছর ধরে তো কেবল পরীক্ষা দিলেই পাস রেজাল্ট পাওয়া গেছে। ফেলের আকাল। প্রায় সব স্কুল-কলেজে শত ভাগ রেজাল্ট । পড়াশোনা না করেই যদি পাস করা যায় তবে পড়াশোনার কী দরকার ? এমসিকিউ টাইপের প্রশ্নের জন্য পাস করা আরো সহজ হয়ে উঠেছে। চোখের ইশারায় একজন শিক্ষার্থী মুহূর্তে পুরো হলের সবাইকে এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিতে পারে। অনেক জায়গায় কোন কোন শিক্ষকও এ অনৈতিক কাজটি করে থাকেন বলে শোনা যায় । পরীক্ষার হলে ঠাসাঠাসি আর গাদাগাদি করে পরীক্ষার্থীরা বসে । খুব সহজে তারা একে অন্যের খাতা দেখতে পারে । কথা বলাবলি করতে পারে । বলাবলি আর দেখাদেখি করে লেখার কারণে পড়াশোনা ছাড়াই অনেকে পরীক্ষায় পাস করার অবারিত সুযোগ পেয়ে যায়। গ্রামে-গঞ্জে আজকাল পরীক্ষার সেন্টার। প্রশ্ন ফাঁস হবে না তো হবেটা কী? পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন হাতে পাওয়া গেলে পড়াশোনার তো দরকারই পড়ে না । 
নব্বই দশকের শুরুতে যেখানে একটি সেন্টারে মাত্র আশি-নব্বই জনে পরীক্ষা দিয়েছি, সেখানে আজ দু'হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী। একটি সেন্টারের জায়গায় চারটা সেন্টার ।

আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেই পুরনো আমলের পরীক্ষা পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে। পরীক্ষার সেন্টার সীমিত সংখ্যক হতে হবে। পরীক্ষার বিষয়, নম্বর ও সময় কমানো যায়  কি না তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। চূড়ান্ত বা ফাইন্যাল পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। পরীক্ষামুখি কারিকুলাম ও সিলেবাস পরিহার করে জ্ঞানমুখী শিক্ষা চালু করতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমুলক শিক্ষার উপর বেশি করে জোর দিতে হবে। আরেকটা কথা, চাকরি পেতে যদি ঘুষ দেয়া লাগে তবে তো পড়াশোনার দরকার পড়ে না। আজকাল অনেক মেধাবী টাকার অভাবে চাকরি যোগাড় করতে পারে না। 

আমাদের প্রজন্মকে পড়ামুখী করতে হবে। প্রচুর পড়াশুনা না করলে  অদুর ভবিষ্যতে আমরা পৃথিবীতে এক মেধাহীন জাতি বলে গণ্য হবো। আমরা ভুরি ভুরি সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারবো বটে, কিন্ত কাজের কাজ কিছু হবে না। আমাদের পড়াশোনায় নীতি-নৈতিকতার ও উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা থেকে সকল বৈষম্য দূর করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভাজন দূর করে শিক্ষা জাতীয়করণের পথ প্রশস্ত করতে হবে। 

লেখক  :  অধ্যক্ষ , চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট , সিলেট এবং  দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032811164855957