এবারের বইমেলা নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা - দৈনিকশিক্ষা

এবারের বইমেলা নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা

মাছুম বিল্লাহ |

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এবারও বাঙালির প্রাণের উৎসব অমর একুশে বইমেলা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। বাংলা একাডেমি, লেখক, প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এখন মেলার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ২০১৭ সালের তুলনায় এবার মেলার পরিসর বাড়ছে বলে সংবাদ এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। তার অর্থ হচ্ছে, মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে। আনন্দের সংবাদ নিশ্চয়ই। শোনা যাচ্ছে, এবারই প্রথমবারের মতো লেখক ও প্রকাশকদের মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশের জন্য পৃথক গেট থাকবে। এই গেট দিয়ে বয়স্ক মানুষ ও সাংবিদকরাও প্রবেশ করবেন। চার দশকে বইমেলা অনেক দূর এগিয়েছে, অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে বইমেলা শুরু হয়েছিল তার সবই কি পূরণ হয়েছে?

একজন মানুষের আয়ুষ্কাল ৬০, ৭০ কিংবা ১০০ বছর। তারপর একদিন তাঁকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। কিন্তু একখানা বই শত শত বছর বেঁচে থাকতে পারে, অবশ্য যদি তেমন বই হয়। তাই ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, ‘রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ একটি বই যে কি অমূল্য সম্পদ তা একমাত্র জ্ঞানীরাই বুঝতে পারেন। বই কেনায় একসময় বাঙালিরা বদনাম কুড়িয়েছিল, যা সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ নামক প্রবন্ধে আমরা দেখতে পাই। তিনি বলেছিলেন, বই কেনা সম্পর্কে বাঙালির উক্তি হচ্ছে ‘অত কাঁচা পয়হা কোথায় বাওয়া, যে বই কিনব?’

আমাদের একুশে বইমেলা এক সাংস্কৃতিক মেলা, আলোর মেলা, জাতিসত্তা প্রকাশের মেলা। এটি মানুষের মিলনমেলাও বটে। মেলায় আগত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা—সবাই স্টল ঘুরে ঘুরে খোঁজেন প্রিয় লেখকের বই। নতুন বই হাতে নিয়ে ভেজা মলাটের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে বাড়ি ফেরেন বইপাগল মানুষ। এটাই তো বইমেলার পরিচিত দৃশ্য। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, যেসব লেখক এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়ে গেছেন, তাঁদের ভালো লেখা পাঠকদের আকৃষ্ট করেছে, তাঁদের বই কেনার প্রতিই পাঠক ও মেলায় আগতদের ভিড় থাকে বেশি। যে প্রকাশনা সংস্থাগুলো এসব নামিদামি লেখকের বই ছাপে তারা আবার বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান দেয় যে উক্ত লেখকের কী কী নতুন বই মেলায় এসেছে। কিন্তু যাঁরা নতুন অথচ ভালো লেখক, তাঁদের কী অবস্থা হবে? আমরা কি নতুন লেখক সৃষ্টিকে উৎসাহ দেব না? তাদের লেখা প্রকাশকরাও ছাপাতে চান না, নিজেরাও ছাপাতে পারেন না। দু-একটি ছাপালেও তার আবার প্রচার-প্রচারণা নেই। এই একটি বৈপরীত্যের মধ্যে প্রতিবছর মেলা শুরু হয়, চলে এবং শেষ হয়।

ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি আমাদের গুরুত্বারোপ করার সময় এসেছে। অনেক উঁচুমানের লেখক আছেন আমাদের দেশে, অথচ তাঁদের লেখা এই বাংলাদেশও হয়তো পশ্চিমবঙ্গে কিছু কিছু পাঠক পড়েন কিন্তু বিশ্ব পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে আরো ব্যাপকভিত্তিক ও মানসম্মত অনুবাদ জরুরি। অন্য ভাষার সাহিত্যও বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়া দরকার।

মনের স্নিগ্ধ রূপ গঠনে গ্রন্থের একটি বিরাট প্রভাব বিদ্যমান। মনের তৃপ্তি ও দীপ্তি গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমেই সম্ভব। গ্রন্থ নির্বাচনে পাঠককে দোকানে গিয়ে পরিশ্রম করতে হয়, একটি দোকানে সব শ্রেণির বই কেনা প্রায় অসম্ভব। বইমেলা মানুষের এ পরিশ্রম অনেক লাঘব করে দিয়েছে। তবে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে বইমেলার পরিসর বেড়েছে, কিন্তু কমেছে আন্তরিকতা। করপোরেট সংস্কৃতির একটা অশুভ বাণিজ্যিকীকরণের ছায়া পরোক্ষভাবে হলেও লক্ষ করা যায় বইমেলা আয়োজনে। এ ছাড়া ই-বুক, ব্লগ ছাপা বইয়ের চাহিদার ওপর প্রভাব ফেলছে। জ্ঞানের জায়গায় যদি তথ্য প্রতাপ তৈরি করে, তাহলে সভ্যতার সংকট তৈরি হতে পারে। তবে কাগজের বই পড়ার যে আনন্দ তা অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। এটিই আসল সত্য কথা।

বাংলাদেশের মানুষের গভীর আবেগ, ভালোবাসা ও গ্রন্থপ্রীতি যুক্ত হয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ধীরে ধীরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ আর রুচি নির্মাণের এক অনন্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। মেলায় অঢেল বই প্রকাশিত হলেও মানসম্পন্ন বইয়ের যে অভাব রয়েছে, পাঠকদের সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ভালো বই কিভাবে পাঠকদের কাছে পৌঁছানো যায় সে বিষয়টি প্রকাশনা সংস্থা ও মেলার আয়োজকদের ভেবে দেখতে হবে।

১৯৭২ সালে মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনে চট বিছিয়ে কয়েকটি বই নিয়ে বসেছিলেন। পরের বছরগুলোতে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরো কিছু প্রকাশক। ১৯৮৪ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় এই মেলা। তখন থেকেই বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে আয়েজিত হয়ে আসছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পাঠক, তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ বইমেলায় আসেন। তার পরও বহু মানুষ এখনো বইমেলার আওতায় আসেননি। তাঁদের জন্য বিভাগীয় ও জেলাভিত্তিক বইমেলা নিয়মিত আয়োজন করা প্রয়োজন। মূল্যবোধের অবক্ষয়, জঙ্গিবাদ, রাজনীতির দৃর্বৃত্তায়ন ও ফেসবুক সংস্কৃতির যুগে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বই পড়াতেই হবে।

 

লেখক: মাছুম বিল্লাহ, লেখক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.017364978790283