এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় লাগামহীন দুর্নীতি - দৈনিকশিক্ষা

এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় লাগামহীন দুর্নীতি

রাকিব উদ্দিন |
এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। অনেক মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক বেশি। প্রতিবছর বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশকিছু মাদ্রাসা থেকে কোন শিক্ষার্থী পাস করতে পারছে না। আবার অনেক মাদ্রাসার সুপার (প্রতিষ্ঠান প্রধান) নিজের খেয়ালখুশিমতো আসা-যাওয়া করছেন। কেউ কেউ পরিচালনা পরিষদকে না জানিয়েই ১৫ দিন ও এক মাসের জন্য লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছেন। পুরনো শিক্ষকদের বরখাস্ত করে ইচ্ছেমতো শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে অনেক মাদ্রাসায়।
 
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত এই ধরনের বিস্তর অভিযোগ জমা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে সাহস পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়। ফলে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও নৈরাজ্য লাগামহীন অবস্থায় চলে যাচ্ছে।
 
বিগত কয়েক বছরের পাবলিক পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই মাদ্রাসা। এমপিওভুক্ত যেসব মাদ্রাসার কোন শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় পাস করতে পারছে না সেগুলোর বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
 
২০১৭ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৮টি শিক্ষা বোর্ডের ৯৩টি প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীই পাস কারেনি, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদ্রাসা বোর্ডের ৮২টি। এই ৮২টি প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটি ছিল এমপিওভুক্ত। এসব মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
 
গত বছর অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় ৫৯টি প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি, যার মধ্যে ২৫টিই মাদ্রাসা বোর্ডের। এর মধ্যে একটি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত। ২০১৬ সালেও জেডিসিতে ২০টি মাদ্রাসায় কেউ পাস করতে পারেনি, যার মধ্যে তিনটি ছিল এমপিওভুক্ত।
 
এ ব্যাপারে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর একেএম ছায়েফ উল্লাহ বলেন, ‘মাদ্রাসায় অনিয়ম একটু বেশি, এটা ঠিক। আবার অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে যেসব অভিযোগ আমাদের কাছে জমা হয় সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। তবে কোন মাদ্রাসার এমপিও বাতিল বা স্থগিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।’
 
জানা গেছে, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধিনে মাদ্রাসা (সরকার স্বীকৃত) আছে ১৬ হাজার ২২৬টি। এর মধ্যে পূর্ণ এমপিওভুক্ত দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা আছে সাত হাজার ৬১০টি। এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন ১ লাখ ২০ হাজার। কর্মচারি আছে প্রায় ৪০ হাজার। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য প্রতি মাসে সরকারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আর ইবতেদায়ি মাদ্রাসা আংশিক এমপিওভুক্ত এমপিওভুক্ত সকল মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী আছে প্রায় অর্ধকোটি। এছাড়াও নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী আছে।
 
এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার যত অনিয়ম ও দুর্নীতি
 
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা এমএস দাখিল মাদ্রাসার সহ-সুপার আবু বকর সিদ্দিক গত ১৪ জানুয়ারি বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, ‘মাদ্রাসাটিতে জেডিসি ও দাখিল পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রস্থিত আছে। কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাদ্রাসার সুপার পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার প্রধানগণদের নিয়ে ছল-ছাতুরীর মাধ্যমে নকল প্রবণতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটিকে পুঁজি করে প্রবেশপত্র ফি এবং নকল সরবরাহ ফি বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা পরীক্ষার্থীদের কাছ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই কাজ নির্বিঘেœ করতে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও ম্যানেজ করেন।’
 
ঝালকাঠীর রাজাপুরে ‘পূর্ব কানুনদাসকাঠী দাখিল মাদ্রাসা’র বিভিন্ন অনিয়মের তদন্ত চেয়ে সম্প্রতি জেলার শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একটি অভিযোগপত্র জমা দেয় স্থানীয় আ. রব হাওলাদার, আ. সোমেদ হাওলাদার, আ. সালাম হাওলাদার, স্বপন হাওলাদার, জসিম হওলাদার ও ফিরোজ হাওলাদার। তারা বলেন, ‘পূর্ব কানুনদাসকাঠী মাদ্রাসা আমাদের পৈতৃক জমির ওপর স্থাপিত। মাদ্রাসাটি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। নিয়মিতভাবে ১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী বেতনভাতা উত্তোলন করছেন। কিন্তু মাদ্রাসায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ছাত্র নেই। শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকেন না, লেখাপড়াও হয় না। এজন্য ছাত্রছাত্রী দিন দিন কমে যাচ্ছে। কিন্তু বেতনভাতা ঠিকিয়ে রাখতে ২০১৭ সালে জেডিসি ও পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় নানা রকম অনিয়মের মাধ্যমে বহিরাগত ছাত্রছাত্রী দ্বারা পরীক্ষার্থী দেখানো হয়।’
 
বাগেরহাটের শরণখোলা ‘বড় রাজাপুর সালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসা’র ম্যানেজিং কমিটির সাবেক শিক্ষানুরাগী সদস্য মিজানুর রহমান গত ১৭ ডিসেম্বর শিক্ষা সচিবের কাছে অভিযোগ পত্রে বলেন, ‘সালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক নাসির উদ্দিনের তিনটি জন্ম তারিখ ও ২টি ইনডেক্স (এমপিও নম্বর)। তিনি প্রথমে এবতেদায়ী শাখায় জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, যার ইনডেক্স নম্বর-০৭০৬৫৯ এবং জন্ম তারিখ ০১/০১/১৯৬০। পরবর্তীতে তিনি এই মাদ্রাসায় কারি পদে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান যার ইনডেক্স নম্বর-৫৮১৩৭৭ এবং জন্ম তারিখ ০৫/০৭/১৯৭৪। আর ভোটার আইডি কার্ডে নাসির উদ্দিনের জন্ম তারিখ ০৫/০৭/১৯৬৪।’
 
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার ‘গুঠাইল সিনিয়র মাদ্রাসা’র পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি আব্দুল হাকিম মিয়াসহ কয়েকজন অভযোগ সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগপত্রে বলেন, ‘গুঠাইল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত থাকছেন। অনুপস্থিত থাকার সময় তিনি কাউকে দায়িত্বও দিয়ে যান না। এজন্য মাদ্রাসার লেখাপড়ায় বিঘœ ঘটছে।’
 
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নায়কের হাট দা: সু: দাখিল মাদ্রাসা’র ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আবুল কাশেম গত ১২ ডিসেম্বর শিক্ষা সচিবের কাছে এক অভিযোগপত্রে বলেন, ‘নায়কের হাট দারুল সুন্নাত দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মৌলভী শিক্ষক আজিজুল হক (ইনডেক্স-২১০৯৪৩৫) এনটিআরসিএ হতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি নাগেশ্বরী আলিয়া কামিল মাদ্রাসায় আরবি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ওই পদে এমপিওভুক্তি হতে না পাড়ায় আগের প্রতিষ্ঠানের ইনডেক্স অনুযায়ী যথারীতি বেতনভাতা উত্তোলন করছেন।’
 
এমপিও’সহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা শাখায় প্রতিমাসে দেড় থেকে ২০০ অভিযোগ জমা হয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জনিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশই অভিযোগই আমলে নেয়া হয় না। এজন্য মাদ্রাসার অনিয়ম, দুর্নীতিও নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
 
গত ২৭ জানুয়ারি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত তার রচিত ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দেশে প্রতি তিনজন ছাত্রের একজন মাদ্রাসার। এটি সামগ্রিক শিক্ষার জন্য ভীতিকর। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী এসব ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। বর্তমানে এ সংখ্যা দেড় কোটি। এদের অর্ধেক কওমি মাদ্রাসার, সেখানে আবার সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।’
 
মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯২ শতাংশ দরিদ্র পরিবার থেকে আসে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার্থী তৈরিতে ব্যর্থ মাদ্রাসা। পরিবারে যে ছেলেটি ‘কম মাথাওয়ালা’ (কম মেধাবী), তাকে মাদ্রাসায় পড়তে দেন অভিভাবকরা। মাদ্রাসায় শিক্ষিত হওয়া ৭৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কোন না কোনভাবে বেকার রয়েছেন।’
 
বর্তমানে দেশে ২৬ হাজার ৮১টি সাধারণ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা এবং ৭৭৫টি কারিগরি কলেজসহ প্রায় ২৮ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও সুবিধা পাচ্ছেন। তাদের এমপিও বাবদ প্রতিমাসে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৯৪০ কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা, যার একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে মাদ্রাসায়।
 
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে মাউশি অধিদফতরের বাজেট ছিল ২৩৫ কোটি টাকার, ২০০৯ সালে যা ছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার। বর্তমানে মাউশি’র বাজেট হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার। এভাবে প্রতিবছরই এমপিও খাতের বরাদ্দ বাড়ছে, কিন্ত মনিটরিং নেই। সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় মাদ্রাসায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বেশি হলেও এগুলোর ওপর মন্ত্রণালয়ের তেমন মনিটরিং নেই বলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0076940059661865