এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে (২ ফেব্রুয়ারি) নতুন ও পুরনো সিলেবাসের প্রশ্ন বিতরণে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে সারাদেশের অন্তত ২০টি পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব ও কক্ষ পরিদর্শকরা। বাংলা ১ম পত্রে সর্বশেষ সেশনের পরীক্ষার্থীকে পুরনো সিলেবাসের প্রশ্ন আর পুরনো সেশনের পরীক্ষার্থীকে নতুন সিলেবাসের প্রশ্ন দেয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অনেক কেন্দ্রে ভুল বুঝতে পেরে সময় বাড়িয়ে নতুন প্রশ্ন বিলি করে আবার পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। অনেক পরীক্ষার্থীকে আবার এমন সুযোগ দেয়া হয়নি। এরফলে বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী কর্তৃপক্ষের এমন ভুলের কারণে কম নম্বর পাবে। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে এর যৌক্তিক সমাধানের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া কয়েকটি জেলার কয়েকটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্রের ফটোকপি দিয়ে পরীক্ষা নিতে হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষার এমসিকিউ অংশের প্রশ্নে লেখা রয়েছে ১০১৯ সালের সিলেবাস অনুযায়ী।
এধরণের ঘটনায় একজন কেন্দ্র সচিব বরখাস্ত, একজনকে অব্যহতি এবং সাত কেন্দ্র সচিবকে কারণ দর্শাতে বলেছে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। আর ঘটনা তদন্তের জন্য শিক্ষা বোর্ডগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। বিভাগের সচিব মো: সোহরাব হোসাইন দৈনিক শিক্ষাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নতুন পুরনো মিলিয়ে বাংলা প্রথম পত্রের তিন ধরণের পরীক্ষার্থী ছিলো। ২০১৯ সালের সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের পাশাপাশি এবার পরীক্ষা দিচ্ছে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের সিলেবাসের পরীক্ষার্থীরা। অন্যান্য বারের মত এবারও ফেল করা ও ইম্প্রুভমেন্ট এর জন্য অনেক পুরনো পরীক্ষার্থী আবার পরীক্ষা দিচ্ছে। তাদের এক সিলেবাসে যেসব গল্প-কবিতা আছে, অন্য সিলেবাসে তার বেশ কয়েকটি গল্প-কবিতা বাদ দিয়ে নতুন গল্প-কবিতা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ফলে এক সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নের সাথে অন্য সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের অনেক প্রশ্নে মিল ছিলো না। এব্যাপারে শিক্ষা বোর্ড আগে থেকেই কেন্দ্র সচিবদের সতর্ক করে নির্দেশনা জারি করেছিলো। কিন্তু অনেক পরীক্ষা কেন্দ্রে সেই নির্দেশনা যথযথভাবে অনুসরণ করতে পারেননি পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা। তারা না বুঝে এক সিলেবাসের পরীক্ষার্থীকে অন্য সিলেবাসের প্রশ্ন দিয়েছেন। এরফলে অনেক পরীক্ষার্থী সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।
রাজধানীর মিরপুর, সভার, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ, বরিশালের বাবুগঞ্জ, জামালপুরের বকশীগঞ্জ, মুুন্সীগঞ্জ, পঞ্চগড়, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীসহ সারাদেশের ২০টিরও বেশি কেন্দ্রে এধরণের ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রথম দিনে বাংলা ১ম পত্রে সৃজনশীল অংশের উপযুক্ত সিলেবাসের প্রশ্ন না দেয়ায় পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন পরীক্ষার্থী বিষয়টি কক্ষ পরিদর্শকদের নজরে আনে। কিন্তু পাত্তা দেননি তারা। পরিদর্শকরা পরীক্ষার্থীদের বলেছেন, ওই প্রশ্নেই পরীক্ষা দিতে হবে। পরে দুপুর বারোটার দিকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে নতুন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে দৈনিক শিক্ষাকে জানিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষক। আবার কয়েকটি কেন্দ্রে পুরনো প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়েই পরীক্ষার্থীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে পুরনো ভুল সিলেবাসের প্রশ্নে পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক তা অস্বীকার করেন। দুপুর দুইটার দিকে দৈনিক শিক্ষার প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এরকম কোনো খবর আমাদের কাছে আসেনি।’
আরও পড়ুন : হাজার বছর আগের সিলেবাসে এসএসসির বাংলা পরীক্ষা!
তবে, ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে জানতে পেরে পুলিশ স্মৃতি পরীক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষকে ফোন করেন। অধ্যক্ষ জানান, প্রথমে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে। পরে আধা ঘন্টা সময় বাড়িয়ে আবার সঠিক প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে।
গোলাম মোস্তফা নামের একজন অভিভাবক বলেন, শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে দুপুর একটায় এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও পরীক্ষার্থীরা বের না হওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে উৎকন্ঠা দেখা দেয়। ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
এরপর আড়াইটায় দৈনিক শিক্ষার পক্ষ থেকে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ কেন্দ্রে যোগাযোগ করা হলে কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘একটু সমস্যা হয়েছে, এখনই পরীক্ষার্থীরা বের হবে।’ কী সমস্যা জানতে চাইলে কোনও মন্তব্য না করে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে জেনে নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ।
এরপর পৌণে তিনটায় অভিভাবক গোলাম মোস্তফা দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, আমার ছেলে এইমাত্র পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বের হয়েছে। তার কাছ থেকে জানতে পেরেছি পুরনো প্রশ্নে লিখিত অংশের পরীক্ষা শুরু হয়। এ সময় কয়েকজন পরীক্ষার্থী তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ওই প্রশ্নেই পরীক্ষা নেয়া হবে বলে জানান কক্ষ পরিদর্শকরা।
তিনি বলেন, দুপুর বারোটার দিকে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে নতুন প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দুপুর একটার দিকে নতুন প্রশ্নে শুরু হয় পরীক্ষা। তিনি আরও জানান, পুরানো প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে দুইজন পরীক্ষার্থী বাসায় চলে গিয়েছিলো। পরে অভিভাবকরা বিষয়টি জানতে পেরে তাদের পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে আসে। নতুন করে এ দুই জনের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে বলে আমরা এইমাত্র জানতে পেরেছি।
আরেকজন অভিভাবক রেবেকা খাতুন জানান, গতবছর যারা পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে কিন্তু এবার ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের সিলেবাস আগের বছরের। আর এবছরের যারা পরীক্ষার্থী তাদের নতুন সিলেবাস। নতুন সিলেবাসে আগের অনেক গল্প-কবিতা বাদ দিয়ে নতুন গল্প কবিতা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। তার মেয়ে এবার পুলিশ স্মৃতি স্কুল কেন্দ্রে ইম্প্রুভমেন্ট পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু বাংলা প্রথম পত্রের নতুন সিলেবাসের প্রশ্ন দেয়া হয় তাকে। সেখানে অনেক প্রশ্ন কমন পড়েনি। বিষয়টি কক্ষ পরিদর্শককে জানালে সবাই একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিচ্ছে বলে জানান তিনি। একারনে ওই পরীক্ষার্থী ৩০ নম্বরের প্রশ্ন ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। বাড়িতে গিয়ে বন্ধুদের কাছে শুনতে পায়, একই ধরণের ঘটনার পর তাদের প্রশ্ন পাল্টিয়ে আবার পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হয়েছে। খবর পেয়ে তারা আবার কেন্দ্রে গেলেও পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি। প্রশ্ন তোলেন, তার মেয়ের ছেড়ে আসা ওই ৩০ নম্বরের বিষয়ে কি হবে। মেয়েকে যেন বঞ্চিত করা না হয় সেব্যাপারে যৌক্তিক সমাধান দাবি করেন তিনি।
অপরদিকে সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়ার কয়েকটি কেন্দ্রেও পুরনো প্রশ্নপত্রে আধাঘন্টা পরীক্ষা হওয়ার পর সময় বাড়িয়ে ফের নতুন প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো: সোহরাব হোসাইন শনিবার বিকেলে দৈনিক শিক্ষাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। কেন ভুল হলো, কীভাবে হলো, কারা দায়ী তা তদন্তপূর্বক মন্ত্রণালয়কে জানাতে বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে সাতটি কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে জানিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাহবুব হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ওই সাত কেন্দ্র সচিবকে ‘শোকজ’ করা হয়েছে। তদন্ত করে বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কতজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে এখনই তা জানাতে পারেন নি তিনি। তবে পরীক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলায় চাম্পাফুল এপিসি স্কুল কেন্দ্রে গতবছরের সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ায় কেন্দ্র সচিব সুখলাল বাইনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রায় তিন ঘন্টা পর নতুন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার্থীদের আবার পরীক্ষা নেয়া হয়।
এদিকে, বাংলা ১ম পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে মারাত্মক ভুল ধরা পড়েছে। আজ শনিবার অনুষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে বাংলা ১ম পত্রের এমসিকিউ অংশে লেখা রয়েছে ১০১৯ সালের সিলেবাস অনুযায়ী। কিন্তু এখন ২০১৯ সাল চলছে।
এছাড়াও ঢাকা সাভারের অধরচন্দ্র বিদ্যালয়সহ কয়েকটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র কম হওয়ায় ফটোকপি করা প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া সাভারের আহাজ্ব জাফর ব্যাপারী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রেও পুরনো সিলেবাসে পরীক্ষা দিতে হয়েছে পরীক্ষার্থীদের। তাদের সময় বাড়িয়ে না দেয়ায় সৃজনশীল অংশের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। এতে তারা পরীক্ষায় কম নম্বর পাবে বলে মনে করছেন। মন্ত্রণালয়ের কাছে তারা এর একটি সমাধান চান।
অপরদিকে কয়েকজন কেন্দ্রসচিব দৈনিক শিক্ষাকে জানিয়েছেন, ‘পুরনো সিলেবাসের প্রশ্ন, অথবা প্রশ্ন কম হওয়া--এসব সমস্যার জন্য বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।’