ছাত্রলীগ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্রলীগ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। যার ফলে ছাত্রলীগের ইতিহাসই বাঙালির ইতিহাসে পরিণত হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে ছাত্রলীগের মতো ত্যাগী ও গৌরবময় ছাত্রসংগঠন নেই, যারা লড়াই-সংগ্রামে আত্মত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতা এনেছে। শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি—এই নীতিতে বিশ্বাসী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের জানুয়ারি থেকে মার্চের উত্তাল সময় এবং তৎপরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ গঠন, পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃসময়ে প্রতিবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ এ দেশের যাবতীয় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। এককথায় এ দেশের ইতিহাসের প্রতিটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সঙ্গে সংযুক্ত আছে ছাত্রলীগ। আমি নিজেকে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে খুবই ধন্য মনে করতাম। কৈশোরে যখন আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম, আমার আশপাশের মানুষজন আমাকে যে সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দিয়েছিল তা আমি এখনো অনুভব করি। অথচ আজ সেই ছাত্রলীগের ঐতিহ্য, সম্মান হয়ে গেছে অনেকটাই ম্লান। পত্রিকার পাতায়, টক শোতে, আড্ডায়—সর্বত্রই বয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের সমালোচনার ঝড়। এই ঝড় ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীদের জন্য যে কতটা কষ্টের তা বলে বা লিখে কোনোভাবেই বোঝানো যাবে না। যে ছাত্রলীগের জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে রাজপথে থেকেছি, সেই ছাত্রলীগকে যখন অন্যরা অবজ্ঞা করে, ছাত্রলীগকে নিয়ে কটু কথা বলে তখন বুকে মনে হয় শেল বিঁধে। শনিবার (৪ জানুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ধূসর থেকে ধূসরতর হচ্ছে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য, খসে পড়ছে গৌরবের পালক। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে শিক্ষাঙ্গন ও পাড়া-মহল্লা, নগরে-বন্দরে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি বেচা-কেনা, ছাত্রাবাস দখল, ভর্তি ও সিট বাণিজ্য ইত্যাদিতে মেতে উঠেছে এবং ক্রমে এসব স্বার্থের সংঘাতে নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষ, মারামারি ও খুনোখুনি পর্যন্ত করছে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধেও আসছে ছাত্রলীগের নাম। ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য আজ এতটাই বেড়েছে যে তারা শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করছে না। অনেক সাধারণ ছাত্র তাদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতন এমন পর্যায়ে অনেক সময় চলে যাচ্ছে যে বুয়েটের আবরারের মতো ছাত্ররা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। ছাত্রলীগ আজ বেপরোয়া, লাগামহীন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাজে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তাদের পদ থেকে সরিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু তার পরও ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা যায়নি। জনমনে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—সেই আদর্শবাদী ছাত্রলীগ এখন কোথায়? কেন হারাল ঐতিহ্য? ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কেনই বা একের পর এক কলঙ্কিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে? কেন বারবার বেপরোয়া, বেসামাল ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে তারা? এর উত্তর একটাই। সেটা হচ্ছে, আজকের ছাত্রলীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারছে না। তারা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পক্ষে কোনো ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নমূলক কাজ করা সম্ভব নয়। ছাত্রলীগের মধ্যে আগাছা, পরগাছা ঢুকে গেছে। ছদ্মবেশী অনেকেই ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে অনেক রকম কুকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। আদর্শ না থাকলে কুকর্ম করাটাই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। অনাহৃত ছদ্মবেশী আগাছারা সংগঠনে ঢুকে নানা কুকর্ম করে সংগঠনটির গায়ে কালিমা লেপন করে চলছে। এরা খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁস, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত থেকে এই গৌরবান্বিত সংগঠনটির ঐতিহ্য নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের সজাগ থাকতে হবে। নতুন কর্মীকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। না হলে ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে ছদ্মবেশী ভিন্নমতাবলম্বীরা নানা কুকর্ম করে সংগঠনটিকে আরো বিতর্কিত করে তুলবে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, আজকের ছাত্রলীগের ঐতিহ্য নষ্ট হওয়ার কারণ হচ্ছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আদর্শের পরিবর্তে অর্থ, বিত্ত-বৈভব অর্জনকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। খুব সহজেই কোটিপতি হওয়ার বাসনা তাদের পেয়ে বসেছে। একটা সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যখন নিজেরা না খেয়েও সংগঠনের নেতাকর্মীদের দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়াত, আর এখন শুনি অনেক ছাত্রলীগের নেতাই দামি দামি গাড়িতে চড়ে, প্লেনের টিকিট না দিলে কোনো সম্মেলনে যেতে চায় না। বিলাসী জীবনযাপনের মোহ তাদের পেয়ে বসেছে। তারা দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা ভুলে শুধু সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতির কথাই চিন্তা করছে। এ অবস্থান থেকে, এ মানসিকতা থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যদি সরে না আসে, তবে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ফিরে আসবে না। এখন শুনি যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বই পড়ে না। শুধু ফেসবুকিং, আড্ডা আর নেতাগিরি করে বেড়ায়। ছাত্রলীগকে বই পড়ার প্রতি অধিক মনোযোগী হতে হবে। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের খুঁটিনাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কর্মীদের অধ্যয়নের প্রতি উৎসাহিত করতে শীর্ষনেতাদেরই প্রেরণামূলক নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজন করে সেখানে যুগে যুগে সংঘটিত বিভিন্ন বিপ্লব ও বিপ্লবীদের জীবনী, বিভিন্ন দেশের দেশনায়কদের জীবনী পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র কর্ম ও জীবন সম্পর্কে যেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পুরো ধারণা নিতে পারে, সে রকম হাজারো বই আছে, যা পড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যদি বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণরূপে জানতে পারে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার কথা জানতে ও বুঝতে পারে এবং হৃদয়ে ধারণ করতে পারে, তবে ছাত্রলীগের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আজকের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার একটাই প্রত্যাশা—ছাত্রলীগ ফিরে পাক তার হারানো গৌরব। আর এই গৌরব ফিরে পাবে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণকারী আলোকিত তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে।
বাহালুল মজনুন চুন্নু : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।