ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের দেওয়া বিশেষ ওএমএস সুবিধাভোগী দরিদ্রদের তালিকা থেকে ৩৩৭ জন ধনাঢ্য ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। জেলা খাদ্য বিভাগ ও পৌরসভা যাচাই-বাছাই করে তাদের বাদ দেয়। এর আগে তালিকা তৈরিতে অনিয়ম করায় দুই কাউন্সিলর ও এক ডিলার বরখাস্ত হন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গোকর্নঘাট এলাকার অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির নাম দরিদ্রদের তালিকায় পায় খাদ্য বিভাগ। তালিকায় থাকা নাজির মিয়ার দুই ছেলে বিদেশে। প্রায় ২ কোটি টাকার মালিক তিনি। এরফানুল বারী নামে আরেক জনের বাজারে মার্কেট আছে। আছে দোতলা বাড়ি। আবদুল হেকিমও মার্কেটের মালিক। বাজারে মার্কেট আছে রোকসানা বেগমের। তিনি আবার কাউন্সিলর প্রার্থী। ধন মিয়ার চার ছেলে বিদেশে। আছে পাকা বাড়ি।
গোকর্নঘাট বাজারের সবচেয়ে বড় মার্কেটের মালিক সামছুল হক। তালিকায় আছে তার নামও। রবীন্দ্র বর্মনের দুই ভাই থাকেন বিদেশে। ৩০০ শতাংশ জমির মালিক তিনি। হোসেন মিয়ার দোতলা বাড়ি, তাতে লাগানো এসি। বাজারে দোকান আছে তার। দুটি মাইক্রোবাসের মালিক শফিক মিয়া। কবির মৃধা বড় ব্যবসায়ী। বিত্তশালী এই মানুষের নাম তালিকায় রয়েছে অথচ সেখানে ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সাধারণ শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, চায়ের দোকানদার, হিজড়া সম্প্রদায়ের লোকজনের নাম নেই, যেটা থাকার কথা ছিল। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ফেরদৌস মিয়ার নেতৃত্বাধীন এ সংক্রান্ত কমিটি এই তালিকাটি তৈরি করে।
গণমাধ্যমে অন্য আরেকটি ওয়ার্ডের অনিয়মের চিত্র প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগ তদন্তে নামে। শুরু হয় পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডের তালিকা যাচাই-বাছাই। প্রথম দফায় প্রত্যেক ওয়ার্ডে করা ৫০০ জনের নামের তালিকার খোঁজখবরে সন্ধান মেলে এই ‘দরিদ্র’ ধনীদের। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় মোট ২৪ সম্পদশালী শনাক্ত হন। খাদ্য বিভাগের আকস্মিক যাচাইয়ে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মহল্লার সর্দার ও দোতলা বাড়ির মালিক কিতাব আলী, যার দুই ছেলে প্রবাসী এবং সাত রুমের দুই ইউনিটের বাড়ির মালিক মো. আবদুর রউফ, দোতলা বাড়ির মালিক জীবন সাহা, নেরোজ আলী, সাকিল ও উপল মালাকারের নাম পাওয়া যায় ঐ তালিকায়।
১২ নম্বর ওয়ার্ডে সৌদি প্রবাসী তিন ছেলের পিতা বাচ্চু মিয়া, দেশে সরকারি চাকরিরত এক সন্তানের মা হেনেরা বেগম, দুই প্রবাসীর পিতা নারায়ণ ঋষি, দোতলা বাড়ির মালিক ও ধান ব্যবসায়ী শওকত ওসমান, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হারুন অর রশিদ, কাউন্সিলরের পরিবারের সদস্যসহ ৩৩ জন, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ডিলারের স্ত্রী-সন্তান ও স্বজন, কাউন্সিলরের কয়েক ভাই, একাধিক পাঁচতলা বাড়ির মালিক ও লন্ডন প্রবাসীসহ ২২ জন, ২ নম্বর ওয়ার্ডে সাত জন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পাঁচতলা বাড়ির মালিক মো. আবু বাকের, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে আট জন, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে দুই জন এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এমন আরো সাত জনের নাম চিহ্নিত হয়।
জেলা খাদ্য অফিস জানায়, দৈবচয়ন ভিত্তিতে ভোক্তা তালিকা যাচাই করে মোট ১৩১ জন সামর্থ্যবান খুঁজে পান তারা। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসক ও ওএমএস কমিটির সভাপতি হায়াত-উদ-দৌলা খান লিখিতভাবে পৌর মেয়রকে তালিকা যাচাই-বাছাই করতে বলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলররা সামর্থ্যবানদের নাম বাদ দিয়ে সংশোধিত তালিকা পাঠায় খাদ্য অফিসে। এর মধ্যে ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ১৫ জন, ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চার জন, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ৩৫ জন, ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ৬১ জন, ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ২২ জন, ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ১২ জন, ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ১৭ জন, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ৫০ জন এবং ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ২৪ জনের নাম সংশোধন করে তালিকা জমা দেন।
সব মিলিয়ে ৩৩৭ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে প্রথম দফায় করা ৬ হাজার জনের তালিকা থেকে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবির নাথ চৌধুরী জানান, তালিকা যাচাই-বাছাই করে পৌরসভা থেকে তাদের কাছে এখনো সংশোধিত তালিকা দেওয়া হচ্ছে। তারা ঐ তালিকা অনুসারে নতুন ভোক্তার নামে কার্ড ইস্যু করছেন। প্রত্যেক ওয়ার্ডে ১ হাজার ৬০০ জন করে এই পৌরসভায় মোট ১৯ হাজার ২০০ জন বিশেষ ওএমএস সুবিধে পাবেন। যদিও তালিকা তৈরির কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি।
এদিকে এ তালিকা তৈরিতে অনিয়মের কারণে ১০ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মাকবুল হোসাইন ও রফিকুল ইসলাম নেহার সাময়িক বরখাস্ত হন। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ডিলার মো. শাহআলমের ওএমএস ডিলারশিপ বাতিল করা হয়।