কচুরি পাঁচালী - দৈনিকশিক্ষা

কচুরি পাঁচালী

আমিরুল আলম খান |

অন্তত এটা ঠিক, কচুরিপানা বিষাক্ত নয়। ওর জ্ঞাতি-গোষ্ঠি অনেকেই আমাদের খাবার পাতে বহুকাল ধরেই আছে। শুধু গরিবের পাতে নয়, ভদ্রলোকের খাবার টেবিল, এমন কি দামি হোটেলেও ওর জ্ঞাতিভাই কচুর কন্দ, লতি, ডাঁটা, পাতা অভিজাত খাবার। খাদ্যগুণেও কম নয়। চিংড়ি, নোনা ইলিশ দিয়ে কচুর লতির স্বাদ কে  ভুলতে পারে? টাকিমাছ-কচুপাতার ভর্তা যে খেয়েছে সেই মজেছে।

শুধু কি কচু? ওলের কথাই বিবেচনা করুন। কন্দ হিসেবে ওল উপাদেয় খাদ্য। নারকেল দুধ দিয়ে ওলের ডাঁটা রান্না ভোজন রসিকদের ভীষণ পছন্দ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাটকেলঘাটা, চুকনগর, সাতক্ষীরার মানকচু, ওল বিখ্যাত। রুই মাছের সাথে সাতক্ষীরার ওল, মানকচু গত শতকেও ছিল অব্যর্থ ভেট।

কচুরিপানা খাওয়া যেতেই পারে। ওতে প্রচুর পরিমাণে আইরন, ক্যালসিয়াম আছে। যেটুকু বিছুটি আছে তা তেঁতুলে দূর হবার কথা। টমেটোও চলতে পারে। একটু বেশি তেলে চিংড়ি দিয়ে রান্না হলে উপাদেয়, সুস্বাদু খাবার হবেই। শুটকিতেও জমতে পারে। ইলিশ হলে সোনায় সোহাগা। চাইলে নারকেলের দুধ দিয়েই কচুরির ডাঁটা রাঁধতে পারেন। ডিমের সাথে কচুরি ফুল ভেজে খাওয়া যায়। বেসন দিয়ে পাকোড়াও সুস্বাদু। যারা কুমড়ো, বকফুল, বরুণ ফুল ভাজা খেয়েছেন তারা কচুরির ফুল ডিম দিয়ে বা বেসন সহকারে পাকোড়া করে খেয়ে দেখতে পারেন।

কচুরিপানা যে সুখাদ্য এবং পুষ্টি ভরপুর তাতে আমার সন্দেহ নেই। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী ভালো প্রজেক্ট দিয়েছেন। কচুরিপানার বৈজ্ঞানিক নাম Eichhornia crassipes. আইকর্নিয়া নামটি এসেছে প্রুসিয়ান রানীর নাম থেকে। রানী এই ফুলের রূপে মুগ্ধ ছিলেন। বিলাসী রানীর বিশাল টবে চাষ হতো এই ফুল।

এক বর্ষা রাতে টব থেকে এর একটি চারা বাইরে ভেসে যায়। তারপর নদীতে। নদীর স্রোতে গেল ভেসে বহুদূর। গরম পেয়ে দ্রুত বংশ বিস্তার ঘটতে লাগল। বংশবিস্তার এত দ্রুত হল যে অল্পদিনের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এখন তো দুনিয়া জুড়ে কচুরিপানা। 

ফুলের সৌন্দর্যে শীতের দেশের রানী যতই মুগ্ধ হন না কেন গরম দেশে এসে তা রীতিমত উৎপাত হয়ে ওঠে। মশার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রজনন ক্ষেত্র এই কচুরিপানা। ব্রিটিশ আমলে যশোরে ম্যালেরিয়া এমন ছড়িয়ে পড়েছিল যে শহর ছেড়ে অর্ধেক মানুষই পালিয়ে যায়। সেকালে ম্যালেরিয়ার ভয়ে কোনো রাজকর্মচারী যশোর যেতে রাজি হতো না।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে জানা গেল, মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়। তার নিরাপদ আশ্রয় এই কচুরিপানা। পঞ্চাশের দশকে তাই ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই চলে যায় কচুরিপানার বিরুদ্ধে। সেকালের পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের অন্যতম অঙ্গীকার হয়ে গেল মশা ও ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। হাবিবুল্লাহ বাহার ঢাকা শহর মশামুক্ত করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে অমর হয়ে আছেন। আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে মশা তথা কচুরি নিধনের অঙ্গীকার করবেন। তিনি এর বাংলা নাম জানতেন না। জনসভায় ইংরেজি নাম ‘হায়াসিন্থ’ সাফা করার প্রতিজ্ঞা করলেন। পিছন থেকে ছোটনেতার প্রমোট করলো, ‘বলুন, কচুরিপানা।’ তিনি কষ্টেসৃষ্টে উচ্চারণ করলেন ‘কচুড়ি পোনাহ’। লোকে হেসে কুটিকুটি।    

এমনিতেই শীতের সময় কচুরি মরে যায়। নোনা পানিতেও বাঁচে না। মাছচাষে কচুরিপানার ব্যবহার আছে। গরমে পানি শীতল রাখে। মাছ কচুরিপানার নিচে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। ওর দাঁড়ির মতো শেকড়ের ভাজে ভাজে মাছ আশ্রয় নেয়। চিংড়ি, কই মাছের খুব প্রিয় আবাস এই কচুরিপানা। চাষীরা অগ্রহায়ণ মাসে কচুরিপানা তুলে চিংড়ি, কই মাছ ধরে। পটলের খেত কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেয় চাষী। তাতে ফলন বাড়ে। পচলে উত্তম জৈব সার হয়। কার্তিকে ডুবা ঘাস খেয়ে গরুর মড়ক লাগে। তখন গরুর নিরাপদ খাদ্য এই কচুরিপানা। নির্মাণ কাজে সিমেন্ট কিউরিং-এ এর ব্যাপক ব্যবহার আছে। জ্বালানী হিসেবেও মন্দ নয়।

আইয়ুব খাঁ দেশজুড়ে কচুরিপানা নিধনে রাসায়নিক স্প্রে করে বিল বাওড় বিষাক্ত করে ফেলেন ১৯৬০ দশকে। 

রানী আইকর্নিয়াকে ধন্যবাদ। তাঁর প্রিয় ফুলটি এখন আমাদের নানা কাজে লাগছে। আর রানীও অমর হয়ে আছেন এই কচুরিপানার নামে তাঁর নামটি নিয়ে। তা না হলে কে আর রানী আইকর্নিয়ার নাম মনে রাখত?

আমাদের ইনোভেটিভ পরিকল্পনামন্ত্রী একটি ভালো আইডিয়া দিয়েছেন। এটা নিয়ে গবেষণা করার বিরাট সুযোগ এসেছে। খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করুক, গবেষণা করুক। এ প্রকল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে অর্থ, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সেল গঠিত হোক। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ নির্দেশ জারি করে বিশেষ ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে।

লেখক : আমিরুল আলম খান, শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান যশোর শিক্ষা বোর্ড।

ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073919296264648