করোনাভাইরাসের কালো থাবা পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আয়, পর্যটন, ওষুধ, ইলেকট্রনিক, নিত্যপণ্য, মেগাপ্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতে। শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশসহ চীননির্ভর বিভিন্ন পণ্য আমদানি কমছে। দেশের বেশির ভাগ আমদানি পণ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চীন থেকে এক মাসের ব্যবধানেই পণ্য আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ। ফলে রাজস্ব আয় কমেছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। বন্ধ রয়েছে চীনে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি। ৬৫ শতাংশ চামড়া রপ্তানির এ বাজার বন্ধ থাকায় অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা ক্ষতির হিসাব করেছেন শিল্পের উদ্যোক্তারা। শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ফারুক মেহেদী।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ট্যারিফ কমিশনের প্রাথমিক হিসাব বলছে, আমদানি-রপ্তানি সংকুচিত হওয়ায় কয়েকটি খাতেই অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। কাঁচামালের মজুদ কমছে। ফলে উৎপাদনে টান পড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘চীনের ওপর আমাদের কাপড়, সুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের নির্ভরতা আছে। একদিকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি, অন্যদিকে দেশীয় বাজারে সরবরাহের জন্য পণ্য। দুইদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চীনের অফিস-কারখানা খুলতে শুরু করেছে। তবে এখনো সবাই ঠিকমতো অফিস করা শুরু করেনি। ওদের বন্দরের কার্যক্রম এখনো ঠিকমতো শুরু হয়নি। আরো দুই সপ্তাহ পরে সত্যিকার অর্থে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বোঝা যাবে। উদ্যোক্তা ও উৎপাদকরা এরই মধ্যে অবশ্য বিকল্প খোঁজা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে পণ্যের ব্যয় বেড়ে যাবে।’
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল মামুন। তিনি বলেন, ‘এত দিন ছুটির কারণে শিপমেন্ট বন্ধ ছিল। এখন আবার উৎপাদন শুরু হয়েছে দেশটিতে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে পণ্যের শিপমেন্ট শুরু হয়ে যাবে।’
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি—প্রায় এক মাসে চীন থেকে আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে মোট আমদানি
হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ২৯ টন পণ্য। আর ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়েছে চার লাখ ১৭ হাজার ১১৯ টন। দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে আমদানি কমেছে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার ৯১০ টন বা ২৬.৫৬ শতাংশ। রাজস্ব কম আদায় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গেল প্রায় এক সপ্তাহে এলসি খোলার হার প্রায় ৩৭ শতাংশ কমে গেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে অনেক পণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন কেমিক্যাল, রং ইত্যাদি শিল্পে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঁচামালের দামও বাড়ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার এম ফখরুল আলম গতকাল বলেন, এখনো যেসব পণ্য আমদানি হচ্ছে তার বেশির ভাগ সরকারের চলমান মেগাপ্রকল্পের। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রাবন্দর, মেট্রো রেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পের নির্মাণ উপকরণ। এসবের কোনো শুল্ক নেই, রাজস্ব আয় নেই। বড় প্রভাবটা দেখা যাবে আগামী মার্চ-এপ্রিলে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বলা যায় বস্ত্র ও বস্ত্রজাতীয় পণ্য, গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজসহ বিভিন্ন উপকরণে চীনের ওপর নির্ভরতা প্রায় ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া অন্তত ৪০ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশও আনতে হয় চীন থেকে। এটা এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘ক্ষতি হচ্ছে, তবে তা বিক্ষিপ্তভাবে। টাকার অঙ্কে তা কত—এ হিসাব আমরা এখনো করিনি। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে আমরা একটি সেল খুলেছি। এই সেল ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার ক্ষতির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাবে কেমন ক্ষতি হচ্ছে।’ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘চীননির্ভরতার কারণে অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিতে ওভেন খাত। নিটে কোনো সমস্যা নেই।’
এফবিসিসিআই সূত্র জানায়, গেল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য ছিল প্রায় ১৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ৮৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ২৫টি সংগঠনের মতামত নিয়েছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, ‘অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানার জন্য আমরা বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়েছি, নিচ্ছি। যদি পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হয়, তবে নেতিবাচক হতে পারে। বিশেষ করে ওভেন ও সুয়েটার খাতে এর প্রভাবটা বেশি হবে। নিটে আমাদের চীনের ওপর নির্ভরতা নেই। ওই খাতে তেমন প্রভাব পড়বে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চীনের বিকল্প বাজারও খুঁজছি। অন্য দেশে এলসি খুলতে বলেছি ব্যবসায়ীদের।’
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যেও বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। মোট রপ্তানি বাণিজ্যের ৬৫ শতাংশই হয় চীনে। এখন পুরোপুরি বন্ধ। ট্যারিফ কমিশন প্রাথমিক হিসাবে বলেছে, করোনার প্রভাবে এ খাতে ক্ষতি প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, ‘আমরা যখন ট্যানারি স্থানান্তরের সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি, কমপ্লায়েন্ট ইস্যুতে যখন ইউরোপের বাজারে আমাদের প্রতিবন্ধকতা চলছে তখন অনেক কষ্টে চীনে কম দামে আমাদের বাজারটি সম্প্রসারণ করা শুরু করলাম। তখনই করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়ল। অনেকেই খেলাপি হওয়ার পথে।’
ক্ষতির মুখে পড়েছে ওষুধশিল্পও। এ শিল্পের কাঁচামালের ৫০ শতাংশ আসে চীন থেকে। ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব সফিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের মোট কাঁচামালের প্রায় অর্ধেকই আসে চীন থেকে। এখন স্টক আছে দুই থেকে তিন মাসের। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তবে ওষুধশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমরা ভারত থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ আনতে পারব। কিন্তু তারাও স্টক নেই বলে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।’
চীনের ওপর নির্ভরতা আছে নিত্যপণ্য আদা, রসুনের। এসবের এখনো দাম লাগামহীন না হলেও ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। অবশ্য শ্যামবাজার পেঁয়াজ রসুন ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীন থেকে আমদানি বন্ধ হলে কিছু ব্যবসায়ী দাম বাড়ার আশায় হিমাগারে সংরক্ষণ করে। তবে এখন সেগুলো বাজারে ছাড়তে শুরু করায় দাম কমে গেছে।’
আরও পড়ুন :
করোনা ভাইরাস : প্রাণ গেল ২৭৬৪ জনের
করোনা ভাইরাস : প্রাথমিক স্কুলে সচেতনতা বৃদ্ধির নির্দেশ
করোনা ভাইরাস : রূপ নিচ্ছে বৈশ্বিক মহামারিতে