ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবী এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুগে যুগে পৃথিবীতে মহামারি এসেছে বটে। করোনা ভাইরাসের মতো বৈশ্বিক মহামারি এর পূর্বে কোনোদিন এসেছে বলে জানা নেই।
সারা পৃথিবী লকডাউন হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে বাঁচার এই একটিই পথ। বিজ্ঞান বলি আর চিকিৎসা বিজ্ঞান বলি, করোনা নামক ভাইরাসটির কাছে আজ ব্যর্থ। প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার দম্ভটি আর মানুষের নেই। মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞান আজ প্রকৃতির কাছে তুচ্ছ বিষয়। প্রকৃতির হাতে মানুষ নিছক খেলার পুতুল। করোনা ভাইরাস হয়তো সেই সত্যটি জানান দিতে এসেছে।
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে কেউ কোথাও ভালো নেই। ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশ অসহায় দাঁড়িয়ে লাশের মিছিল প্রত্যক্ষ করছে। আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশের জন্য কোন পরিণতি অপেক্ষা করছে, কে জানে? সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত ছাড়া বাঁচার পথ নেই। সব চেষ্ঠা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর ইতালির প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষজনক সে ইঙ্গিত দিয়েছেন। আমাদের গ্রামপ্রধান জনবহুল দেশ। যে কোনো দুর্যোগ মহামারিতে গ্রামপ্রধান জনবহুল দেশগুলো ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়। অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো চড়া মূল্য দিয়ে থাকে। ধর্মান্ধতা ও সামাজিক কুসংস্কার ভয়াবহ পরিণতিকে কেবল ত্বরান্বিত করে। ঘরে থাকার সহজ কাজটি আমাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। নানাভাবে বলে কয়ে সরকার আমাদের ঘরে আটকিয়ে রাখতে পারে না। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী নামিয়েও মানুষজনকে ঘরে বসিয়ে রাখা কঠিন। গ্রামের মানুষজন মহামারির কিচ্ছু বুঝে না। উল্টো এরা তামাশা করে। ধর্মের নামে ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে সরকারের বদনাম খোঁজে। গ্রামের মানুষকে আগে সচেতন করা জরুরি। তা না হলে আমাদের বেশি খেসারত দিতে হতে পারে।
বহুল প্রত্যাশিত মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে করোনা মহামারি সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকে গ্রাস করে বসে। এর ভয়াল ছাপ প্রথমে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উপরে পড়ে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লকডাউন হয়ে যায়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ থেকে ছিটকে পড়ে। প্রিয় শ্রেণিকক্ষ আজ খালি পড়ে আছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী নেই। সকাল দশটার আগে যে জায়গাগুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠতো, সেখানে আজ কবরস্থানের নীরবতা বিরাজ করে। দেশে সবার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লকডাউনের কবলে পড়ে। শিক্ষকেরা নিত্যদিনের কাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে যান। চির চেনা শ্রেণিকক্ষ ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের মুখগুলো আজ তারা দেখতে পান না। শ্রেণিকক্ষই শিক্ষকের উপযুক্ত স্থান। যেমন মায়ের কোল সন্তানের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। প্রিয় শিক্ষার্থীদের জন্য দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। একদিকে এদের পড়াশুনার ভারি লোকসান হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এদের জীবন নিয়েও উৎকণ্ঠার শেষ নেই। প্রিয় শ্রেণিকক্ষ আর শিক্ষার্থীদের দ্রুত ফিরে পাবার এক অজানা কষ্ট তাদের পেয়ে বসেছে।
বৈশ্বিক এই দুর্যোগের সময় লকডাউন হয়ে যাবার কারণে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বেড়ে গেছে। মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ চলাফেরা করে নিজের আহারের সংস্থান করেছে। দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকার অভ্যাস তাদের নেই। আজ পরিস্থিতির কারণে মানুষ স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি। ঘরে বসে অন্নের সংস্থান করা তার জন্য দুরূহ কাজ হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক এই মহামারিতে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার সাথে আজ গোটা মানুষ জাতির বসবাস। শিক্ষকেরা মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সমাজ নন। করোনার এই বৈশ্বিক মহামারিতে শিক্ষক সমাজ একদিকে শিক্ষার্থীদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, অন্যদিকে পরিবার পরিজন নিয়ে শঙ্কিত। এই মহা দুর্যোগে পৃথিবীতে মানব জাতির অস্তিত্ব নিয়েও তাদের আশঙ্কা কম নয়। এর উপর নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার দুশ্চিন্তা। বহুমুখি দুশ্চিন্তা। বেসরকারি শিক্ষকদের আজ বহুমাত্রিক চিন্তায় পেয়ে বসেছে।
আজ যদি তারা সরকারি শিক্ষক হতেন, তবে তাদের এত দুশ্চিন্তার দরকার হতো না। বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠান থেকে বেতনের যে অংশটি পান, সেটি এখন অনেক জায়গায় বন্ধ। বহু স্কুল-কলেজ আছে, যাদের ফান্ডের অবস্থা ভালো নেই। স্কুল-কলেজ খোলা নেই বলে জানুয়ারির পর থেকে ছাত্র বেতন আদায় হচ্ছে না। বাড়ি ভাড়া ১০০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা। করোনা মহামারিতে টুকটাক টিউশনি পড়ানোরও সুযোগ নেই। দু’ আনা দু’ পয়সা বাড়তি ইনকাম নেই। যারা লকডাউনের কারণে নিজ বাড়ি থেকে শত মাইল দূরে অন্য কোনো জায়গায় অবস্থান করছেন, তারা এখন কোন পরিস্থিতে আছেন কে জানে? তারা বাড়ি ভাড়া কীভাবে দেবেন? আল্লাহ না করুক, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা দিয়ে করোনার সময়ে চিকিৎসা করাবেন কী করে? আমাদের ডাক্তারেরা কত যে অমানবিক। আজ ইউরোপ আমেরিকার দেশে অবসরে যাওয়া ডাক্তাররা করোনার চিকিৎসা দেবার জন্য হাসপাতালে ফিরে আসছেন। আমাদের ডাক্তার ও নার্সেরা করোনার ভয়ে হাসপাতাল ছেড়ে পালাচ্ছেন। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন কঠিন সময়ে ৫০০ টাকা দিয়ে বেসরকারি একজন শিক্ষক নিজের চিকিৎসা করবেন, নাকি পরিবারের অন্যদের চিকিৎসা করাবেন? বেসরকারি জানলে শিক্ষকের প্রতি কোনো কোনো ডাক্তার আলাদা অবহেলা দেখিয়ে থাকে।
গত সপ্তাহে দৈনিক শিক্ষার মাধ্যমে করোনা দুর্যোগের সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন বেসরকারি শিক্ষকের কষ্টের কথা দেশের মানুষ জানতে পেরেছে। একজন শিক্ষক পরিবার পরিজনের দু’মুঠো খাবার যোগাড় করার জন্য ‘পাঠাও’ চালাতে গিয়েছেন। আরেকজন দু’তিন দিন অনাহারে থেকে ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ফোন করে নিজের কষ্টের কথা জানিয়েছেন। মানব দরদী বলে নির্বাহী অফিসার তার বাসায় খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। অন্য আরেকজন শিক্ষক শিশুর দুধ কেনার টাকা যোগাড় করতে না পেরে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক নাকি অন্য কাকে ফোন করেছেন। তিনিও মানবিক বলে মনে হয় বাচ্চাটির দুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু, এভাবে কয়দিন কয়জনে কয়জনকে দেবে? বৈশ্বিক এই মহা দুর্যোগের দিনে দেশে বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষক এরকম কষ্টের মধ্যে আছেন। তদুপরি সরকারের আদেশ মেনে নিজের ঘরে স্বেচ্ছায় আটকা পড়ে থেকেও নিজের ফেসবুকে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে দেশের মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। পড়াশুনার বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। সম্ভব হলে সংসদ টেলিভিশনে প্রচার হওয়া ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামের অনুষ্ঠান নিজে দেখছেন। শিক্ষার্থীদের দেখতে বলছেন। বিটিভি কেন অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করে না, সে নিয়ে আফসোস করছেন।
শহর আর স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা সংসদ টেলিভিশন চ্যানেলটি দেখতে পেলেও গ্রামের অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা তা দেখতে পারে না। বিটিভিতে হলে সকলে দেখতে পেত। শিক্ষা থেকে কোনো দিন বৈষম্য দূর হবে কি না, কে জানে? বেসরকারি শিক্ষকদের ন্যায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরাও আজ করোনা দুর্যোগে বৈষম্যের শিকার।
বেসরকারি শিক্ষকদের একটি বড় অংশের এমপিও নেই। তারা নন এমপিও। তাদের আজ কি অবস্থা? স্কুল-কলেজ খোলা থাকলে ছাত্র বেতন হিসেবে যে কয় টাকা আদায় হয়, তা ভাগ বাটোয়ারা করে তারা নেন। স্কুল কিংবা কলেজ টাইমের বাইরে টুকটাক কিছু একটা করে আরও কিছু টাকা যোগাড় করেন। উভয়টা মিলে বড়জোর পাঁচ-সাত হাজার হয়। স্বাভাবিক সময়ে সেই টাকা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। আজ করোনা মহামারির এই দুর্দিনে তাদের দুর্দশা ও দুর্গতির খবর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। স্কুল বেতন নেই। বাইরে টুকটাক কিছু করারও নেই। এরা এখন কী করে বাঁচবেন?
বৈশ্বিক এই মহামারির সময়ে গোটা দেশ ও জাতি আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই সময়ে সরকারিকরণ, শতভাগ বোনাস, শিক্ষকদের জন্য রেশন চালুর দাবি করা সমীচীন নয়। বেসরকারি শিক্ষকের কোনো কোনো নেতা রেশন দাবি করছেন। কেউ কেউ বোশেখি ভাতা ও একদিনের বেতন সরকারি ত্রাণ তহবিলে দিতে চাইছেন। অনেকে এসব দাবির পক্ষে বলছেন। কেউ বিপক্ষে বলছেন। এই মহাদুর্যোগে বেসরকারি শিক্ষকদের অনৈক্যের বিষয়টি সব মানুষ জেনে যাচ্ছে। শিক্ষকদের প্রতি সাধারণ মানুষের নিগেটিভ আইডিয়া দিন দিন বাড়ছে। এসব আদৌ ঠিক নয়।
এখন জাতির কঠিন এক দুঃসময়। এই দুর্দিনে সরকার যে ম্যাগা আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, সেটি এই মহাবিপদে দেশের মানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে। এটির সুফল থেকে বেসরকারি শিক্ষকেরা যেন বাদ না পড়েন, এই মুহূর্তে সেই দাবিটি জানাতেই পারি। আরেকটি কথা দৈনিক শিক্ষায় লেখার জন্য বেশ কয়জন সুহৃদ শিক্ষক অনুরোধ করেছেন। সেটি এই- এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন প্রদানকারী বিভিন্ন ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে বেতন থেকে প্রতি মাসে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা কেটে নেয়। তাতে অনেকের বেতনের অর্ধেক টাকা কিস্তিতে কাটা পড়ে যায়। করোনা মহামারির এই সময়ে অন্তত ছয়টি মাস এই কর্তন স্থগিত করা হলে বেসরকারি শিক্ষকেরা উপকৃত হন। করোনার এই বৈশ্বিক মহামারিটি কাটিয়ে উঠে শিক্ষা সরকারিকরণের দাবিটি এ কারণে জানিয়ে রাখি যাতে ভবিষ্যতের কোনো দুর্যোগে শিক্ষক সমাজকে কষ্টের মুখোমুখি আর দাঁড়াতে না হয়। বিশ্বের সকল মানুষ যেন দ্রুত শান্তি ফিরে পায়- পরম করুণাময়ের কাছে আজ আমাদের এই ফরিয়াদ।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।
আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষার আসল ফেসবুক পেজে লাইক দিন
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।