করোনা: দৈহিক এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের যেন মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন না করে - দৈনিকশিক্ষা

করোনা: দৈহিক এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের যেন মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন না করে

আমিরুল আলম খান |

করোনার থাবায় সারা পৃথিবীর মানুষ ঘরবন্দি এখন। এখনও পর্যন্ত এই মারণব্যাধির বিরুদ্ধে এটাই মানুষের জানা একমাত্র প্রতিরক্ষা । দেশ থেকে দেশ, শহর থেকে শহর, পরিবার থেকে পরিবার এমন কি পরিবারের সদস্যরাও নিজের নিজের ঘরে বন্দি। সামাজিক জীব মানুষের এই ঘরে ঘরে বন্দিদশা কতদিন চলবে কেউ জানি না। আবার এ ঘরবন্দি কতটুকু সত্যিকারভাবে মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে তা নিয়েও তরজা প্রচুর। তবু, আপাতত এটাই নিদান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার সে কথাই বলছে। নিজ ঘরে বন্দি থেকে এই দুর্যোগ মোকাবেলা কর, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সামিল হও। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আর যে পরামর্শ, তা হল, বারবার সাবান-পানিতে হাত ধোয়া, চোখে-মুখে হাত না দেয়া, দূরে দূরে থাকা। সাধারণের জন্য এ নিদান।

কিন্তু যারা লড়বেন অন্যেকে সুস্থ করতে সেই ডাক্তার, নার্সদের জন্য এ এক কঠিন পরীক্ষা। তাদের পেশা এখন চরম ঝুঁকিতে। জীবন বাজি রেখে তাদের চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে। এজন্য তাদের সুরক্ষার হাতিয়ারও খুব সীমিত। মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক, হাতে গ্লাভস, পরনে পিপিই পরে তারা নেমেছেন এই যুদ্ধে। জানা কার্যকর কোন ওষুধ নেই। সবই অনুমাননির্ভর, পরীক্ষামূলক। তাই  ঝুঁকিও অনেক বেশি।

জীবন বাঁচানোর এ লড়াই মানব সমাজকে এক অভাবিতপূর্ব বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ মানুষ তো সামাজিক জীব। আরও স্পষ্ট করে বললে, জীবনের ধর্মই একযোগে, একত্রে থাকা। শুধু জীবের ধর্মই বা বলি কেন, জড়বস্তুও তো কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ। তার পরমাণুসমূহ এক সুশৃংখল বন্ধন মেনে চলে। তার সহজ অর্থ হলো, এ মহাবিশ্বে একাকীত্বের জায়গা নেই। সব কিছুই পরস্পর লগ্ন, পরস্পর নির্ভরশীল। এই যৌথ জীবন, এই যৌথ ব্যবস্থা হঠাত ভেঙে দিচ্ছে করোনাভাইরাস। 

মনে হতে পারে বস্তুপুঞ্জের, জীবজীবনের এ এক বিশাল আপাত বিরোধ; কিন্তু না, গভীর দৃষ্টিতে দেখলে, শেষ বিচারে, সে বিরোধ বস্তুপুঞ্জ বা জীবনের প্রবল লক্ষণ নয়। জীবনের প্রবল প্রকাশ  ঐক্যে, একসাথে কাজ করায়, একসাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেবায়। কাজেই ঘরবন্দি জীবন এক সাময়িক ব্যবস্থা। তাই দৈহিক দূরত্ব যেন মানসিক দূরত্ব তৈরি না করে। একবার ভেবে দেখি,  এই ঘরবন্দি জীবনের পাশাপাশি কী অপরিসীম দরদ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমার-আপনার জীবন বাঁচাতে চিকিৎসক, নার্স, তাদের সহকারী, হাসপাতাল কর্মী, এ্যাম্বুলেন্স-কর্মী, অন্যান্য সেবাপ্রদানকারী সংস্থার সদস্যরা দিনরাত কাজ করছেন। বিজ্ঞানীরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন, গবেষণা করছেন কার্যকর  ওষুধ আবিষ্কার, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের লক্ষে। একবার ভাবি, যারা আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির সদস্য তারাও মানুষ। প্রশাসনিক কর্মী, ব্যাংকার, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি সরবরাহে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কথাও ভাবতে হবে। যারা  নোংরা সাফাই করে আমাদের জীবন স্বাভাবিক রাখছেন তারাও মানুষ। যারা প্রতিদিন আমাদের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করছেন, পরিবেশন করছেন সেসব মিডিয়াকর্মী, যারা আমাদের চলাচলে সাহায্য  করছেন সেসব পরিবহণ কর্মী, যারা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ দিচ্ছেন, যারা ওষুধ বিক্রি করছেন তাদেরও ঘরসংসার আছে। তাদের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। নানা পেশার মানুষ নানাভাবে এ যুদ্ধে শরিক; কিন্তু তাদের সকলেই কিন্তু ঘরবন্দি হতে পারছেন না যতক্ষণ তারা সুস্থ আছেন। এক কথায়, মানুষের জীবন বাঁচানোর এ মহাযুদ্ধে আমরা সকলেই যার যার অবস্থান থেকে সামিল। এই কথাটা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। 

তাহলে কথাটা কী দাঁড়ালো? আমরা ঘরবন্দি থাকব সেটা স্রেফ বাঁচার জন্য। দৈহিক এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের যেন মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন না করে। আমরা যে যেখানে যেভাবে আছি আমরা সকলের পাশেই য়াছি এবং থাকব, সেটাই এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার। এইখানে চলে আসে মানবিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, সহমর্মিতার কথা; সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের প্রসঙ্গ। আমাদের সমাজ, আমাদের দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে আমরা একটি বার্তাই পৌছে দিতে চাই, আমরা কেউ একাকী নই; আমরা আছি সবার সাথে, সুখে এবং দুঃখে। আমরা শুধু আমাদের আত্মীয়-স্বজনের কথা ভাবছি না, শুধু আমাদের দেশের মানুষের কথা ভাবছি না, আমরা ভাবছি সমগ্র মানব জাতির কথা। দুনিয়ার যে যেখানে আছি, এ লড়াই আমাদের সকলের, এ আমদের সম্মিলিত সংগ্রাম, মানব জাতির টিকে থাকার সংগ্রাম, মানবিক মূল্যবোধ ঊর্ধে তুলে ধরার সংগ্রাম। 

যে কোন আক্রান্ত মানুষই আমার ভাই, আমার বোন, আমারই পরম আত্মীয়, আত্মার এমন সম্পর্ক বলেই বিশ্ব মানবের এই বিশাল এক সংসার। করোনাআক্রান্ত কারো কাছে যেতে না পারার যে বেদনা তা যেন আমাদের সকলকে সমান স্পর্শ করে, ব্যথাতুর করে। দূর থেকে যেন আমরা বলতে পারি, আপনি একা নন, কেউই একাকী নন, আমরা আপনার সাথেই আছি, পাশেই আছি; স্বাস্থ্য সতর্কতায় শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও আপনি আমাদেরই একজন। 

দেশজুড়ে ঘরবন্দি করতে যে কিছু অমানবিক আচরণের খবর আমরা পড়ছি তার অবসান জরুরি। কাউকে অবহেলা নয়, ঘৃণা নয়, পরিত্যাগ নয় বরং ভালোবাসাই এখন বড় বেশি প্রয়োজন। সত্তরের জলোচ্ছাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ, পশুর সৎকারে আমরা জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। একাত্তরে জীবন বাজি রেখে আমরা উন্মূল মানুষের পাশে থেকেছি, জান-মাল-ইজ্জত বাজি রেখে মুক্তিসেনাদের ঘরে জায়গা দিয়েছি, সম্মিলিতভাবে লড়াই করেছি বলেই আমরা এক বিপুল অসম যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি। আজ আবার সেই যুদ্ধে আমরা সামিল। 

কিন্তু এবারের যুদ্ধ আরও অনেক বড়, পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা শত্রুর গমণাগমনের খোঁজ-খবর পেতাম, শত্রুকে চিনতে পারতাম; কিন্তু করোনাভাইরাস একেবারেই অদৃশ্য শত্রু। তাই এ যুদ্ধ অনেক বেশি ভয়ংকর, অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু মানুষকেই তো এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে, করতে হয়। তাই তো সে আশরাফুল মখলুকাত, সৃষ্টির সেরা। 

এ লড়াই সকলকে একসাথে বাঁধুক। তরুণ-যুব শক্তি এগিয়ে আসুক, এগিয়ে আসুক রাজনৈতিক, সমাজসেবী, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তারাই আমাদের উজ্জীবিত করতে পারেন সবচেয়ে বেশি।  এ লড়াই ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-দেশ নির্বিশেষের। এ লড়াইযেমন দেশীয়, তেমনি বৈশ্বিক।

এই যে দুনিয়াব্যাপী বেঁচে থাকার লড়াই, অন্যের জীবন বাঁচানোর লড়াই তাও বোধকরি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বিশ্ব মানবিক মূল্যবোধকে। এতদিন যে মানুষ অন্যকে শুধুই শত্রু বিবেচনা  করে  ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আসছে, ফেলছে টন টন বোমা, ‘আমরা-ওরা’ বলে পার্থক্যের দেয়াল তুলে দিয়ে আসছিল সবই পরাভূত আজ করোনাভাইরাস সংক্রমণে। সকলেই আজ একই সমতলে এসে দাঁড়িয়েছি। মানুষের জন্য এটাও এক বড় শিক্ষা। 
করোনাভাইরাস হয়ত এক মহত্তম মানব সমাজ নির্মাণের আঁতুড়ঘর হতে যাচ্ছে!

লেখক : আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

[email protected]

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042169094085693