প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা পেয়েছি গ্লোবাল ভিলেজ। সারা পৃথিবী এখন আমাদের এত কাছাকাছি যে সুদূর আটলান্টিকের পাড়ে অথবা সাইবেরিয়ার দ্বীপপুঞ্জে আজ কি হচ্ছে তাও আমাদের অজানা নয়। আজকে হাজার কিলোমিটার দূরের একজন মানুষকে কাছে পাওয়া কত সহজ। কিন্তু সত্যিই কি আমরা কাছাকাছি আসতে পেরেছি? ভালোবাসা, মানবিকতা আর মানসিকতার দিক থেকে আমরা যে কত দূরে চলে গিয়েছি তা বর্তমান সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে স্পষ্ট বুঝা যায়। নিজস্ব সভ্যতা, ধর্মীয় সংস্কৃতি ভুলে আমরা একটি সোনালী সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু সেটা যে অগোচরে কতটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে তা এ করোনা মহামারি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। চারদিকে শুধু সামাজিক দূরত্বের শ্লোগান। মানসিক দূরত্বের পাশাপাশি এই সামাজিক দূরত্ব যে আমাদের আর কত দূর নিয়ে যাবে তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে নতুন করে।
অমানবিকতার কত খবর যে আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে, যা রীতিমত উদ্বেগের উৎকণ্ঠার। সেদিন একটি পত্রিকায় দেখলাম, করোনায় আক্রান্ত মৃত বাবাকে রেখে সন্তানেরা পালিয়েছে। পালানোর বাইরে কি নিজেকে সামলে নিয়ে মৃত বাবার জন্য কি কিছুই করণীয় ছিল না তাদের? বগুড়ায় একজন মারা যাওয়ার পর করোনা সন্দেহে তার দাফন সম্পন্ন করার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি তার স্ত্রী ও তার কাছে যাচ্ছিল না। ঐ এলাকার কোনো মানুষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বাস্থ্যকর্মী কেউ না। পরে প্রায় দশ কিলোমিটার দূর থেকে এক সাহসী যুবক একাই তার লাশ দাফন করার জন্য উদ্যোগী হয়। কিন্তু এলাকার লোকজন কোথাও তাকে কবর দিতে দিচ্ছিল না। পরে তাকে অনেক দূরে সরকারি খাস জমিতে দাফন করা হয়। এরপর তার নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় লোকটি করনায় আক্তান্ত ছিল না। এভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রবাসীসহ করোনায় আক্রান্ত পরিবারের সাথে অমানবিক আচরণ লক্ষ করছি। অথচ ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন থেকে বলা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি থেকে করোনা ছড়ায় না। করোনা মৃত ব্যক্তির শরীরে চার ঘণ্টা বেঁচে থাকে মাত্র। এজন্য তাকে কবর দিতে কোনো সমস্যা নেই।
এমনিতেই যারা করনায় আক্রান্ত বা যাদের পরিবারের সদস্য মারা যাচ্ছে তারা মানসিকভাবে কতটা বিদ্ধস্ত অবস্থায় আছে তার উপর এই অমানবিক আচরণ আমাদের সমাজের জন্য কতটা শোভনীয়? আমরা কি তাদের প্রতি মানবিক হতে পারি না? দূরত্ব ও সতর্কতা বজায় রেখেও কি তাদের সাথে ভালো আচরণ করা যায় না?
গার্মেন্টস শ্রমিকদের সারাবছর ঘাম ঝরিয়ে তাদেরেকে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করা বিত্তবানরা। এই দুর্যোগ মুহূর্তে তাদের একমাসের অগ্রীম বেতন দিয়ে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত কি করতে পারতেন না? বাসার কাজের বুয়া সারাবছর মালিকদের আরামে থাকার সু-ব্যবস্থা করেছে। এ দুঃসময়ে তাদের দায়িত্ব কি আমরা নিতে পারি না? অথচ আল্লাহ তায়ালা পরকালে অধিনস্তদের সাথে আমাদের আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।
এ দুর্যোগে সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোথায়? এতদিন যে তারা লোক দেখানো আর সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য জনগণের বন্ধু সাজার চেষ্ট করেছে তা আজ স্পষ্ট বুো যাচ্ছে। এই মুহূর্তে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, সমাজের নেতা ও সুপরিচিত ব্যক্তিদের নিষ্ক্রিয়তা ভাবিয়ে তুলছে আমাদের গন্তব্য সম্পর্কে।
সমাজের হাজারও অসংগতির মধ্যে যে কোনো আলোকছটা অবশিষ্ট নেই তা নয়। অনেক মানুষ আজও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। টিভিতে একটা নিউজ দেখে চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। একজন মহিয়সী মহিলা নিজে খাবার রান্না করে, নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে একাই পথের অসহায় বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের খাবার বিতরণ করছেন। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ঐ নারী কেঁদে কেঁদে হাতজোড় করে বিত্তবানদের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান করছেন।
মহান আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘তোমরা মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ কর। আশা করা যায় তোমরাই সফল হবে।’ আমাদের নবী (স.) বলেছেন, ‘যে মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ করে না আল্লাহ ও তার কল্যাণ করে না।’ আমাদের সবাইকে একদিন মরতে হবেই। মানবিক মানুষগুলোই ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকবে চিরদিন।
তাই সবার প্রতি প্রত্যাশা থাকবে, আমরা দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। অসহায় মানুষের পাশে দাড়াই। অসুস্থ ও আক্রান্ত ব্যক্তিদের ও তার পরিবারের সাথে ভালো আচরণ করি। করোনা আমাদের জীবনের সীমানাকে খুব কাছে নিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে আমরা হিংসা বিদ্বেষ পরিহার করি। অপরকে ক্ষমা করতে শিখি। পরিবারের সদস্য আত্মীয়-স্বজন ও অধিনস্তদের বেশি বেশি খোঁজ-খবর রাখি। সামাজিক এই দূরত্ব যেন হয় মানসিকভাবে কাছে আসার এক মহা নিয়ামক।
লেখক : মো. আল-ইমরান, প্রভাষক (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি), ছালাম-আবাদ শরীফ আহমদীয়া সিনিয়র মাদরাসা, জামালপুর সদর, জামালপুর।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]