করোনা মোকাবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা জরুরি - দৈনিকশিক্ষা

করোনা মোকাবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা জরুরি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশে যেমন বাড়ছে করোনা-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, তেমনি মৃতদের তালিকাও ক্রমেই বড় হচ্ছে। অবস্থা এখন এমন যে মৃত এবং আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ শুনতেই যেন আমরা টিভি খুলে বসে থাকি, ঠিক ২টা ৩০ মিনিটে। এই তালিকার দৈর্ঘ্য যে বাড়তেই থাকবে, তা প্রকাশ্যে বলতে কারও আর দ্বিধা নেই। আমেরিকাকে মডেল বানিয়ে এবং সে দেশের মৃত্যুর হিসাব দেখিয়ে ‘আমরা এখনো ইউরোপ-আমেরিকার থেকে ভালো আছি’ জাতীয় বুলি কোনাভাবেই বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। মঙ্গলবার (২ জুন) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, খুব অবাক করা বিষয় হলো এত দিন ধরে যেসব দেশের সঙ্গে তুলনা করে সরকারি মন্ত্রীরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন, কোভিড-১৯ বিষয়ে কিন্তু আবার তুলনা সেসব দেশের সঙ্গে চলছে না। কারণ সেসব দেশের প্রতিটির অবস্থাই বাংলাদেশ থেকে ভালো। যেমন কথায় কথায় মন্ত্রীদের অনেকেই সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করতেন, কিন্তু কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সিঙ্গাপুর আর আমাদের তুলনায় নেই। আমরা বেছে বেছে খারাপ অবস্থার দেশগুলোকে টেনে এনে আমাদের দেশ ‘ভালো অবস্থায়’ আছে এবং এখন সব কিছু ‘স্বাভাবিক’ আছে সেটি প্রমাণের জন্যই মরিয়া হয়ে উঠেছি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রতিটি দেশের করোনা বিস্তারের ধরন, চিকিৎসাব্যবস্থা, সরকারের দায়দায়িত্ব এবং জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার সচেতনতার ওপরই নির্ভর করছে একটি রাষ্ট্রের এই মুহূর্তে ভালো থাকা না-থাকা। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ মোটেই ভালো নেই। আর এই ‘নেই’র সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরও অন্তত দুবছর এই করোনাকে সঙ্গে নিয়েই থাকার মতো দুঃসংবাদ। তাই শুধু বর্তমানেই নয়, এই দুই বছরের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিয়েই এখনকার তাগাদা। আমরা ইতিমধ্যেই আরও জেনে গেছি, রাষ্ট্র খুলে দিয়েছ দ্বার, দিয়েছে এই বার্তা—আক্রান্ত ও সুস্থ হওয়া সবই যার যার নিজের দায়িত্ব। এখানে সরকারের দায় এবং দায়িত্ব খুবই কম। ব্যক্তির ওপর ছুড়ে দিয়েছে বাঁচা-মরার সিদ্ধান্তের জটিল সমীকরণটি।


যখন পর্যন্ত পরিচিতদের কারও করোনা শনাক্ত হয়নি, তত দিন পর্যন্ত মনে হয়েছে করোনা দূরের রোগ—আমাকে/আমাদের ছোঁবে না। কিন্তু করোনা অল্প সময়েই সেই দূরত্ব অতিক্রম করে চলে এসেছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের আঙিনায়। এখন আর মনে হয় না, সে দূরে দেখা পাখি। আগে করোনা-আক্রান্তদের দূরে ঠেলে, একলা ফেলে একা একা বাঁচার চেষ্টা করেছে অনেকে। ‘আমি-সে’ কিংবা ‘আমরা-তারা’ এই দ্বি-বিভাজনেই সামাজিকভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে করোনার সংকট। কিন্তু এখন আর ‘তারা’ নেই। করোনা সংক্রমণের ধারালো গতি এখন সব ‘আমরা’তে নিয়ে গেছে। এই এক মাস আগেও ছিল নিজে বাঁচি, কিন্তু করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে নিজে একা বাঁচার সুযোগ নেই, তাই এখন সবাই চেষ্টা করছে সবাইকে নিয়ে বাঁচার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিল উৎকণ্ঠা। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে আমাদের একজন সহকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল মারা গেছেন। জেনেছি আরও দুজন সহকর্মী আক্রান্ত। এই সহকর্মীদের সবাই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই থাকেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত রয়েছে। কিন্তু রোখা যায়নি করোনার ছোবল। আমরা জানি আগে-পরে হয়তো আমরা সবাই আক্রান্ত হব, তাই আমাদের জন্য আসলে কী করণীয় আছে সেটি নিয়েই এখন কথা তোলা প্রয়োজন। আমাদের মন কিছু তথ্যে অভ্যস্ত হয়ে গেছে—কোভিড হাসপাতালগুলো রোগীর তুলনায় ভয়াবহভাবে অপ্রতুল। সরকারি ৪-৫টি হাসপাতালে আইসিইউর বেডও খুবই কম। কিন্তু রোগী কয়েক হাজার। যে হাসপাতালগুলো করোনার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেরই উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্যই নেই। কোভিড হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হওয়া এতটাই কঠিন যে খুব কম রোগীই তার সন্ধান পান।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র এখন এতটাই নাজুক যে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে, আগামী কয়েক দিনে যত মানুষ আক্রান্ত হবে, ঢাকা শহরে সেই সব মানুষের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষমতা নেই এই শহরের হাসপাতালগুলোর। এখন অনেকেই হয়তো বলবেন, করোনা-আক্রান্ত সবার হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কার কখন প্রয়োজন হবে সেটিও আমরা কেউ জানি না। সরকার মুখে সব হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার কথা বললেও কার্যতই সেটি চলছে না অনেক জায়গাতেই। ভেন্টিলেশন, আইসিইউ—এগুলোর সংকট তো ভয়াবহ। এখন এই পর্যায়ে এসে সরকারের মুখস্থ বুলিকে পাশে রেখে কমিউনিটি পর্যায়ে কিছু করা যায় কি না, সেই বিষয়ে আমরা মনোযোগ দিতে পারি। তাতে হাসপাতালগুলো নিয়ে হতাশাও কমবে। যেখানে, যাদের ছোটখাটো মেডিকেল সেন্টার চালু আছে, সেখানে কীভাবে আসলে এই পরীক্ষা এবং চিকিৎসা সহজ করা যায়, সেদিকে আমরা ভাবনাচিন্তা শুরু করি।

মেডিকেল সেন্টারগুলোর কথা এলেই প্রথমেই মনে আসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালিত হাসপাতাল। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে মেডিকেল সেন্টার। সেগুলোর অবস্থা হয়তো খুব বেশি ভালো নয়। তবে এই সময়ে কীভাবে সেটি ভালো সার্ভিস দিতে পারে, তার ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেই বিষয়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই পরিকল্পনা জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রাবায়োলজি বিভাগের তত্ত্বাবধানে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল করোনার সংক্রমণ পরীক্ষা। কিন্তু গত ৩১ মের পর থেকে এটি আর চালু নেই। অর্থনৈতিক সংকট এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। এখন আবার কীভাবে এসব চালু করা যায়, নতুন করে তার পরিকল্পনা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই। কারণ এই ঘাতক কোভিড-১৯ আমাদের সঙ্গে থাকবে আরও কয়েক বছর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ই করতে পারে সেই বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে।

পাশাপাশি, নমুনা সংগ্রহের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ, মাইক্রাবায়োলজি বিভাগসহ আরও কিছু বিভাগের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে (যাঁরা আগ্রহী হবেন, কিছু সম্মানীসহ), কিংবা কোনো সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত করোনা টেস্টের খরচ অনেকটাই বেশি। এই টাকা দিয়ে অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষেই করোনা টেস্ট করানো সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার বিনা মূল্যে এই টেস্ট করাতে পারে। এর পাশাপাশি মেডিকেল সেন্টারে অন্তত ৫০টি আইসোলেশন বেড এবং অক্সিজেনের ব্যবস্থা কিছু মাত্রায় রাখা যেতে পারে। আরও পারে একটা ছোটখাটো করোনা ইউনিট প্রস্তুত করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসকদের করোনা চিকিৎসার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে (যেটি বঙ্গবন্ধু পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে চাকরিরত চিকিৎসকদের মধ্যে শুরু করেছে)।

আমাদের এখন যে সম্পদ আছে সেটিকে কার্যকর শক্তি হিসেবে পরিণত করাই সবচেয়ে জরুরি। ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’ হয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। রাষ্ট্র এবং সরকারের চরিত্র দেখে আমরা ক্রমাগত জিব কামড়াচ্ছি, তবুও আমরা নড়াচড়া করছি, একত্র হয়ে বাঁচার চেষ্টা করছি। এক সঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনকে বড়সড় পরিকল্পনা করতে হবে নিজেদের মেডিকেল সেন্টারগুলো নিয়েই। হোক না ছোট, তবু শিক্ষার্থীরা দৌড়ে সেখানেই প্রথম যাবেন এবং আস্থার জায়গাটি পাবেন।

লেখক : জোবাইদা নাসরীন, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052659511566162