করোনাকালে অনলাইন-টিভি ক্লাসেও সঙ্কট যাচ্ছে না - দৈনিকশিক্ষা

করোনাকালে অনলাইন-টিভি ক্লাসেও সঙ্কট যাচ্ছে না

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনার ছোবলে চার মাস ধরে বন্ধ প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাস্তর পর্যন্ত দেশের পুরো শিক্ষাঙ্গন। ক্ষতি কিছুটা পুুষিয়ে নিতে ‘মন্দের ভাল’ হিসেবে অনলাইন ও টেলিভিশনে কোনমতে ক্লাস চললেও তাতে সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। আবার করোনার ভয়াবহতা অব্যাহত থাকায় শিক্ষা কবে আগের পরিবেশে ফিরতে পারবে তারও নেই সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর। কিন্তু শিক্ষার এই সঙ্কট উত্তরণের উপায় কি? মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনও সঙ্কট উত্তরণে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করা না হলেও দেশের শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাস্তবতা মাথায় রেখে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী। শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনায় একটি জাতীয় কমিটি গঠনেরও সুপারিশ করে শিক্ষাবিদরা বলেছেন, শিক্ষাকে রক্ষায় কৌশল বের করতেই হবে। মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।  প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিভাষ বাড়ৈ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষা কমিটির সুপারিশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুপারিশ করে শিক্ষাবিদরা বলেছেন, মনে রাখতে হবে করোনার কারণে সৃষ্ট আর্থিকসহ নানা সঙ্কটে দরিদ্র পরিবারের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে। একই কারণে বন্ধ হয়ে যাবে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চাকরিও হারাবেন বহু শিক্ষক-কর্মচারী। তাই দীর্ঘ মেয়াদী এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিকল্পনাও হতে হবে দীর্ঘ মেয়াদী। আগামীতে ছুটি কমানো, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো ও অব্যাহত রাখা, শিক্ষকদের ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করে বিশেষ ক্লাস নেয়া, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষা এক মাস পিছিয়ে নেয়া, এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার একমাসের মধ্যে ফল প্রকাশ ও ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু, উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম আস্তে আস্তে সচল করার কৌশল বের করাসহ একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে প্রথম দফায় গত ১৭-৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত দফায় দফায় বন্ধের মেয়াদ বাড়ছে। এর মধ্যে ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরীক্ষাসূচী স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কোনমতে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা গেলেও উত্তীর্ণদের কবে কলেজ ভর্তি করা যাবে তা বলা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে আগামী ৯ আগস্ট থেকে কলেজ ভর্তিতে অনলাইনে শুরু হবে আবেদন প্রক্রিয়া।

করোনাকালে উচ্চশিক্ষার দু’একটি প্রতিষ্ঠান অনলাইন বা ভার্চুয়ালি একাডেমিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই তা সম্ভব হয়নি। আবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম ‘বাংলাদেশ সংসদ টেলিভিশন’র মাধ্যমে প্রচার করা হলেও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা ওই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরই মধ্যে গুজব ছড়িয়েছে ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। একটি অসাধু চক্র ইতোমধ্যেই নামে বেনামে এই গুজব ছড়িয়েছে। যা নজরে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও। মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঈদের পরে খোলার কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।

জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সরকারের যে অবস্থানের কথা বলেছিলেন শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের অবস্থান এখনও সেখানেই আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, অর্থনীতি বাঁচাতে জীবনযাপনে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করার কথা বললেও এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে না।

করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তার কমার পরই কেবল সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাববে। স্কুল এখন আমরা খুলব না। স্কুল কেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটাও খুলব না। সেটা আমরা কখন খুলব? অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্কুল-কলেজ সবই বন্ধ থাকবে। যদি তখনও করোনাভাইরাসের প্রকোপ না কমে তবে যখন এটা থামবে আমরা তখনই খুলব। বেশি সমাগম যেন না হয়।

সরকারের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক শ্রেণীর মানুষ শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে মিথ্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিষয়ে আমরা এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেইনি। শিক্ষা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে গুজব ছড়ানো হলে বা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মন্ত্রী।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ জাকির হোসেন বলেছেন, করোনার এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, যে পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার একটি তারিখ দেয়া হয়েছে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে না। এজন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করতে আমাদের সরকার ইতোমধ্যে ঘরে বসে শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টিভির মাধ্যমে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ আকরাম-আল-হোসেনও জানালেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা নেই। তবে বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের দেখতে হবে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

কিন্তু শিক্ষার এই সঙ্কট উত্তরণের উপায় কি? প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কেবল অনলাইনে এভাবে ক্লাস নিলেই সঙ্কটের সমাধান হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কি কি সঙঙ্কট সামনে আসছে তা খুঁজে বের করার পরামর্শ তাদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত শিক্ষার চলমান সঙ্কট সমাধানে ভবিষ্যতের কোন পরিকল্পনার কথা জানায়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, দুই মন্ত্রণালয়ই সঙ্কট চিহ্নিত করার কাজ করছে। কিভাবে সেই সঙ্কট উত্তরণ করা যাবে তাও বের করার চেষ্টা করছে।

এখন পর্যন্ত কিছু পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ হলেও কোন মন্ত্রণালয়ই তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। সেই সঙ্গে পরের শিক্ষাবর্ষ কমিয়ে নয় মাস করার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনা করে যদি ছুটি বাড়ানো হয় তাহলে এই শিক্ষাবর্ষ মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে জানান আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক। তিনি বলেছেন, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মূলত দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা যায় এবং দ্বিতীয়ত মেধার মূল্যায়নের দিকটি যেন আপোস করতে না হয়।

জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষ বাড়ানো হলে আগে যেমন নবেম্বর ডিসেম্বরে সমাপনী পরীক্ষা হতো সেই পরীক্ষা হবে সামনের বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে। সামনের শিক্ষাবর্ষ ১২ মাস থেকে ৯ মাসে নামিয়ে আনার কথা ভাবা হচ্ছে। একটি শিক্ষাবর্ষে ১৪০ দিনের মতো পড়ানো হয়। বাকিটা ছুটি থাকে। তাই পরের শিক্ষাবর্ষের সমাপনী পরীক্ষা যেন ডিসেম্বরেই নেয়া যায়, সে জন্য সিলেবাস কমানোর পাশাপাশি ঐচ্ছিক ছুটি বাতিল করা হতে পারে।

মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, চলমান অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না, এটা ধরেই মন্ত্রণালয় তিনটি বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা নিয়েও ভাবছে মন্ত্রণালয়। একজন কর্মকর্তা সরকারের তিনটি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, বছরের শুরুতে পুরো তিন মাস ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। এখন চলছে জুলাই মাস। চলতি শিক্ষাবর্ষের জন্য সামনে আরও পাঁচ মাস আমাদের হাতে রয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যেও যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাবর্ষ সম্পন্ন করার পর বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারী ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটিগুলোতেও ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হবে।

দ্বিতীয়ত এ পরিস্থিতি যদি আরও তিন থেকে চার মাস স্থায়ী হয়, তাহলে চলতি শিক্ষাবর্ষ। আগামী বছর ফেব্রুয়ারি বা মার্চ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারী ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ক্লাস চলবে। তৃতীয়ত করোনা প্রাদুর্ভাবের ভেতরেই যদি পুরো শিক্ষাবর্ষ চলে যায়, সে ক্ষেত্রে পরিকল্পনা হলো শিক্ষার্থীদের ‘কোর কম্পিটেন্স’ বা যোগ্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণীর জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হবে।

তবে বর্তমান এই মহাসঙ্কটে অগোছালো কোন প্রক্রিয়ায় সঙ্কট সমাধানের চিন্তা পরিহার করার সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের।

করোনাকালে শিক্ষার সঙ্কট উত্তরণে কিছু সুপারিশ করেছেন সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, আমাদের ভবিষ্যত ভিন্ন রকম হবে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আগামীতে কিছু ক্লাস সরাসরি, কিছু অনলাইনে এবং কিছু অফলাইনে নিতে হবে। শিক্ষকদের ভূমিকাও বদলাতে হবে। পরীক্ষাপদ্ধতিও পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর থেকে শিক্ষকদের এ বিষয়ে আগেভাগেই প্রস্তুত করে তুলতে হবে। কলেজে ভর্তি ও এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া এক সঙ্গে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম খান। তার মতে ভর্তি এবং ফল প্রকাশের দুইটি পৃথক সফটওয়্যার ইন্টারফেসিং করার মাধ্যমে খুব সহজেই ফল প্রকাশ ও কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া একত্রিত করে দেয়া সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, করোনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ বাড়বে অপরদিকে অভিভাবকদের আয় সাময়িক হলেও কমবে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নানাদিক ভাবতে হবে এখন থেকেই। আগের মতো গাদাগাদি করে শ্রেণী কক্ষে বসানো যাবে না। স্যানিটাইজেশন ও জ্বর মাপার যন্ত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে হবে স্কুল-কলেজগুলোকে। তাই দুই ধরনের অনলাইন পদ্ধতির শিক্ষাদান শুরু করার উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। একটা সাময়িক অনলাইন পদ্ধতি ও আরেকটি চিরকালের জন্য কিছু বিষয়ে অনলাইন পদ্ধতিতেই যেতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে, এমনকি লকডাউন কিছুটা শিথিল করে হলেও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। অনির্দিষ্টকাল ধরে লকডাউনে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। এই অচলাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও ‘জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি’র সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির বলছিলেন, দীর্ঘ বন্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর ছুটি কমাতে হবে, বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে এর বিনিময়ে শিক্ষকদের ইনসেনটিভ দিতে হবে। নবেম্বরে পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা একইদিনে সকাল ও বিকেলে নিতে হবে। তবে এই সময়ে সিলেবাস সম্পন্ন না হলে এই দুটি পরীক্ষাও একমাস পিছিয়ে নেয়া যায়।

এই শিক্ষাবিদ বলেন, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলোÑ এইচএসসি পরীক্ষা নিতে না পারা। এই পরীক্ষা নেয়ার একমাসের মধ্যেই ফল প্রকাশের পাশাপাশি ভর্তির আবেদনও শুরু করতে হবে। শিক্ষকদের ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করে এই পরীক্ষার ফলও দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা যাবে। এভাবে পরীক্ষার সময় ও ছুটি কমানো হলে এবং বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করলে আগামী দু’তিন বছরের মধ্যে একাডেমিক ও পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় জটিলতা নিরসন হবে বলে মনে করছেন অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের একটি বছর যে পিছিয়ে যাচ্ছে সেটি আগামী দুই বছরের মধ্যে যাতে সমন্বয় করা যায় সে ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যদি এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করা না যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে নানা সমস্যা তৈরি হবে। এছাড়া শিক্ষকদের জন্য একটা নির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।

প্রবীণ শিক্ষক নেতা ও ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহম্মেদ বলেন, আমি কোন অটোপ্রমোশনের পক্ষে নই। প্রয়োজনে সময় কমিয়ে পরীক্ষা নিতে হবে। তিন ঘণ্টার স্থলে আড়াই ঘণ্টা পরীক্ষা নেয়া যায়। তবে এই সঙ্কটের সমাধান এককভাবে বের করাও সমীচীন নয়। গ্রামাঞ্চলের তৃণমূলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজেই শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব স্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়েই করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। সঙ্কট উত্তোরণে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ নিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, করোনার পর শিক্ষার্থীদের ভীতি কাটাতে সব প্রতিষ্ঠান স্যানিটাইজার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল উচ্চ শিক্ষার সঙ্কট ও তার উত্তরণ নিয়ে এখনই বেশি উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শই দিয়েছেন। দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থানা বিষয়ের অন্যতম এই বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, হ্যাঁ বন্ধ যদি বেশি হয়। যদি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ হয় তাহলে সেশনজট কিছুটা তো হবে। তবে যদি দেড় দুই মাসের বন্ধ হয় তাহলে প্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষা ক্যালেন্ডার সমন্বয় করে বেশি বেশি ক্লাস ও বেশি সময়ে ক্লাস নিয়ে সমস্যা কাটানো সম্ভব হবে। আবার শুক্র ও শনিবারও তখন ক্লাস নেয়া যাবে। প্রয়োজনে পরীক্ষা একটু এগিয়ে এনে হলেও সঙ্কটের অনেকটাই সমাধান করা যাবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ করোনার সঙ্কট না কাটলে প্রতিষ্ঠান কোনভাবেই খোলা যাবে না। সেক্ষেত্রে সেশনজটের সমস্যা কিছু তো আসবেই। কিন্তু এটাও তো মনে রাখতে হবে এ দুর্যোগ বিশ^ব্যাপী। আগে দেখা যাক কি অবস্থা দাঁড়ায়। এখন তো আর জিয়া, এরশাদের আমলের মতো মাসের পর মাস বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকে না। তখন তো চার পাঁচ মাসও বন্ধ থাকত। তাই আমার মনে হয়, আরও দীর্ঘ মেয়াদী সঙ্কট না হলে আমরা শীঘ্রই উচ্চ শিক্ষার সঙ্কট পুষিয়ে উঠতে পারব।

সঙ্কট যে দিকে যাচ্ছে তাতে এখনই পরিকল্পনা গ্রহণের তাগাদা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূন। তিনি বলছিলেন, মনে রাখতে হবে করোনাকালে যদি ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হয় তাহলে পাশে বসে আর কিছু করা যাবে না। এ অবস্থায় একটি জাতীয় শিক্ষা কমিটি করা উচিত। দুর্যোগকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আবার যাতে কেউ আক্রান্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে কিভাবে চলতে পারি সেই পরামর্শ দেবে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিটি। কারণ নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার না করলে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি একই সঙ্গে বলেন, অনলাইনে ক্লাস চললেও একই সঙ্গে স্বল্প পরিসরে শ্রেণীকক্ষে কার্যক্রম শুরুরও পরামর্শ দিয়েছেন এ উপাচার্য। একই সঙ্গে অনলাইনে পরীক্ষার কথাও ভাবা জরুরী। কারণ মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিন পরীক্ষার বাইরে কেবল অনলাইনে ক্লাস নতুন সঙ্কটের সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সঙ্কট সমাধানে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংসদ টিভি বাংলাদেশের সব এলাকায় দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কেবল অপারেটরদের ব্যবহার করা যেতে পারে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তি করা প্রয়োজন যেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য অল্প খরচে ডাটা প্যাকেজ দিতে পারেন। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ডিভাইস প্রয়োজন। যে সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ডিভাইস নেই তাদের বিনা সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। উপজেলা ও থানা পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস নেয়ার সফটওয়্যারগুলো সরবরাহ করা প্রয়োজন।

তবে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন একটি পরিপূর্ণ ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী। তিনি বলেন, দেরি করে হলেও একটা বিকল্প সমাধানের কথা ভাবতে হবে, শিক্ষা কার্যক্রম পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের উদাহরণটা নেয়া যেতে পারে। তবে মূল লক্ষ্য হবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন ঝুঁকির মুখে না পড়ে।

তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাসে প্রাদুর্ভাবের কারণে মূলত তিনটি ক্ষেত্র ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রথমত শিক্ষা পঞ্জিকা এলোমেলো হয়ে গেছে। সেটাকে একটি ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অর্থাৎ পরীক্ষা কিভাবে নেয়া হবে সেই বিষয়ে যৌথ সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি সিলেবাস সংকুচিত করে এক সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ের ওপর পরীক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সর্বশেষে, স্কুল যখন খোলা হবে তখন কি ধরনের ব্যবস্থাপনার আওতায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে সে বিষয়টিকে নীতিমালায় যুক্ত করার কথা বলেন রাশেদা কে চৌধুরী।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.027822971343994