নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে সংক্রমিত করেছে। এ ভাইরাস ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে ডেকে আনতে পারে মারাত্মক বিপদ। কভিড-১৯-এর কিছু লক্ষণ বেশ সাধারণ। সেগুলো হলো কাশি, জ্বর, কাঁপুনি, মাথাব্যথা। কিন্তু রোগটি মনে হয় এখানেই থামতে রাজি নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটি মস্তিষ্ক, হূদযন্ত্র, কিডনি, ত্বকসহ যেকোনো অঙ্গে আঘাত হানতে সক্ষম।
ডাক্তাররা একটি ঘটনায় এখন বেশ বিস্মিত, যাকে তারা ডাকছেন সাইলেন্ট হায়পক্সিয়া বা হ্যাপি হায়পক্সিয়া বলে। কভিড-১৯ শ্বাসকষ্টের সমস্যার বদলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দিচ্ছে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ‘কভিড টো’, যেখানে ব্যথায় চামড়া ফুলে যাচ্ছে। এছাড়া শিশুদের যেখানে আগে অপেক্ষাকৃতভাবে নিরাপদ ভাবা হচ্ছিল, তারাও এখন নতুন উপসর্গ নিয়ে সামনে এসেছে। অনেকের মাঝে এখন কাওয়াসাকি রোগের লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করেছে, যা কিনা সারা শরীরের রক্তনালিতে প্রদাহ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া রক্ত জমাট বেঁধে স্ট্রোক এবং পালমোনারি এমবলিজমের (ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা) মতো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পিটার হোটেজ বলেন, এটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার যে শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস ক্লিনিক্যাল সিকুয়েলার বৈচিত্র্যময় ধরনের হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন কভিড-১৯-এর এমন অস্বাভাবিক প্রকাশের একটি কারণ হচ্ছে বিশ্বে প্রায় চার মিলিয়ন নিশ্চিত কেস শনাক্ত হয়েছে, যা কিনা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অসুস্থতা। অন্যান্য ভাইরাসের সংক্রমণের সময় এ রকম কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। যেমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা সার্স ভাইরাস এবং এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রকোপের সময় দেখা গিয়েছিল। আরেক বিশেষজ্ঞ স্ট্যানলি পার্লম্যান বলেন, বিশ্বে এখন এত বেশিসংখ্যক কেস রয়েছে যে আমরা এখান থেকে একটা ছোটখাটো রূপরেখা তুলে ধরতে পারি। এটা খুব অবাক করা ব্যাপার হবে, যদি আর কোনো সংক্রমণে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন আক্রান্ত দেখা যায়। এমন ঘটনা কটাই বা ঘটতে পারে। এই পরিস্থিতিই কভিড-১৯ কে বিশেষ করে তুলেছে।
বিজ্ঞানীরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই বিস্তৃত জটিলতার স্বরূপ উন্মোচনের জন্য। এখানে দুটি মূল বিষয়কে সন্দেহের কাতারে রাখা হয়েছে। একটি হচ্ছে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে ইমিউন সিস্টেমের রক্ষণাত্মক প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ায় অন্য যে বিষয়টি সামনে আসতে পারে তা হলো, রক্তের জমাট বাঁধা। এ কারণে সারা দেহের রক্ত সরবরাহ প্রভাবিত হয়, যা কিনা কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে আরো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
রক্ত জমাটসংক্রান্ত জটিলতা রিপোর্ট বলছে, অনেক দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের পালমোনারি এমবলিজম এবং স্ট্রোকের আইসিওতেও নিতে হচ্ছে। চীন, ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রে এ সমস্যা দেখা গেছে। এ জাতীয় সমস্যার সামগ্রিক চিত্র অস্পষ্ট। কিন্তু কিছু বিশ্লেষণ বলছে, এ ধরনের সমস্যা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ৩০ শতাংশের মাঝে দেখা গেছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ৩০ এবং ৪০ বছরের কোটায় থাকা রোগীদেরও স্ট্রোকের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন ডাক্তাররা। প্রফেসর মার্গারেট পিসানি বলেন, আইসিওতে থাকা রোগীদের রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখছি। আমরা স্ট্রোক, মায়োকার্ডিক্যাল ইনফেকশন, পালমোনারি এমবলিজমের ক্ষেত্রে জমাট রক্তের উপস্থিতি দেখেছি, যা কিনা সাধারণ ভাইরাল ইনফেকশন নিয়ে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
রক্ত জমাট বাঁধার এই সমস্যাগুলো কভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নয়, বলেছেন ইভোনে মালডোনাডো। অনেক পরিস্থিতিতে রক্তনালিজুড়ে জমাট বাঁধতে দেখা যায়। ইভোনে বলেন, এখানে যে বিষয়টি অস্বাভাবিক তা হলো এ রোগের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে, যা অন্য রোগের সময় হয়নি । প্রশস্ত রক্তনালিতে জমাট বাঁধার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা ছোট রক্তনালিতেও জমাট রক্ত দেখছেন, যা ক্যাপিলারিয়েস কৈশিক নালি হিসেবে পরিচিত। কভিড-১৯ কে রক্তনালিজনিত সমস্যা হিসেবে দেখছেন ফ্রাঙ্ক রুশিটজকা। তিনি বলেন, ফুসফুস হচ্ছে এর প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র কিন্তু এটি হচ্ছে রক্তনালির সমস্যা।
রক্ত জমাট বাঁধার এ সমস্যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো বিস্তারিত কিছু বলেননি। যদিও প্রদাহকে মূল অপরাধী বিবেচনা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ গবেষকরা বলছেন, জমাট বাঁধা রক্তনালির মাঝে পরিপূরক প্রোটিনের উপস্থিতি ইমিউনের প্রতিক্রিয়াকে সক্রিয় করে। অ্যানেস্থেসিওলজির অধ্যাপক লুসিয়ানো গাটিনোনি বলেন, কভিড-১৯-এর অসংখ্য লক্ষণের মাঝে সাধারণ প্রক্রিয়াটি এন্ডোথেলিয়ামের প্রদাহ বলে মনে করা হয়, কোষগুলোর স্তর যা অভ্যন্তরীণ রক্তনালিতে আস্তরণ তৈরি করে। তার মতে, যেহেতু এন্ডোথেলিয়াম সব জায়গায় উপস্থিত থাকে, তাই বোঝা যায় কেন লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হচ্ছে।
কভিড-১৯-এর সঙ্গে যুক্ত কিছু কিছু রহস্যময় লক্ষণের বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার হতে শুরু করে যখন রক্তনালির সমস্যা প্রকাশ পেতে শুরু করে। গাটিনোনি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, এটি ফুসফুসের অক্সিজেন সরবরাহের সঙ্গে সম্পর্কিত না, বরং অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্তপ্রবাহকে প্রতিবন্ধকতাজনিত সমস্যা।
কভিড-১৯-এর অন্যান্য যেসব প্রকাশভঙ্গি যেমন কিডনি সমস্যা (যেখানে কিনা ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হতে পারে), পায়ের আঙুলে ক্ষত, শিশুদের কাওয়াসকির উপসর্গ এগুলোও রক্তনালির জটিলতার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে লক্ষণ কখনো একটিতে সীমাবদ্ধ থাকে না।
অবশ্য কভিড-১৯-এর রক্তনালির সমস্যা সরাসরি ভাইরাস দ্বারা তৈরি হয়, নাকি শরীরের ইমিউন সিস্টেম দ্বারা তা এখনো অজানা। কোনো কোনো গবেষণা বলছে, সার্স-কোভ-২ যা কিনা কভিড-১৯-এর জন্য দায়ী তা সরাসরি এন্ডোথেলিয়াল কোষে আঘাত হানতে পারে।
সায়েন্টিফিক আমেরিকান