করোনাকালে দেশের মানুষের আয় কমার তথ্য দিয়েছে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা। এর উল্টো চিত্রও আছে। এই সময় সমাজের একটা শ্রেণির আয় বেড়েছে, যারা নতুন করে কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়েছে। করোনা সংক্রমণের তিন মাসে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ব্যক্তি নতুন করে কোটিপতি হয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, করোনা মহামারি চলাকালে এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে তিন হাজার ৪১২ জন। আর গত এক বছরে বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ জন। সব মিলিয়ে গত জুন শেষে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
করোনা মহামারির এই সময় দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক হিসেবে উল্লেখ করছেন অনেকেই। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সুবিধাভোগীদের একটা অংশ ঋণের টাকা ব্যবসায় না খাটিয়ে আমানত হিসেবে ব্যাংকে রাখতে পারে।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড়ের কারণে করোনার সময়ও অনেকেই ভালো ব্যবসা করেছেন এবং লাভের টাকা আমানত হিসেবে ব্যাংকে ঢুকিয়েছেন। সব মিলিয়ে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার সময় অনেক খাতেই ভালো ব্যবসা হয়েছে। অথচ তারাও অন্য সব খাতের মতোই ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় পেয়েছেন। এতে তাদের হাতে যে অতিরিক্ত অর্থ রয়ে গেছে, সেটা হয়তো তারা আমানত হিসেবে ব্যাংকে রেখেছেন। আবার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা হতে পারে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খতিয়ে দেখা উচিত। যদিও এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণের যথাযথ ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
করোনার সময় কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক মনে করেন কি না জানতে চাইলে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছুটা অস্বাভাবিক তো বটেই। তবে করোনার প্রভাব কোটিপতিদের ওপর পড়েছে বলে মনে হয় না। প্রভাবটা পড়েছে মূলত দরিদ্র,নিম্নবিত্ত,নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর।
দেশে কোটিপতির প্রকৃত সংখ্যার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে আমানতকারীর ব্যাংক হিসাব থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে গত মার্চ পর্যন্ত দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। গত জুনে তা বেড়ে হয়েছে ৮৬ হাজার ৩৮ জন। ফলে করোনাকালের তিন মাসে কোটিপতি বেড়েছে তিন হাজার ৪১২ জন।
এ সময় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারী। জুন শেষে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৮৮২। তিন মাস আগে মার্চে যা ছিল ৬৪ হাজার ৭২৬। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট বেড়েছে তিন হাজার ১৫৬টি।
এ ছাড়া গত জুন শেষে পাঁচ কোটি এক টাকা থেকে ১০ কোটির মধ্যে ৯ হাজার ৫২৯, ১০ কোটি এক টাকা থেকে ১৫ কোটির মধ্যে তিন হাজার ৩০৫, ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৪৩০, ২০ কোটি এক টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ৯৯২, ২৫ কোটি এক টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে ৬০৫, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটির মধ্যে ৩৮৩, ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ২২৪, ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটির মধ্যে ৪১৮ এবং ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজার ২৮৩ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, প্রতি বছর আমাদের দেশের যে অর্থনীতি বা জিডিপির আকার বের হয়,সেটা সমভাবে বণ্টন হয় না। এর মানে হলো,ধনীরা ধনী হচ্ছে আর গরিব হচ্ছে আরো গরিব। একটি দেশের আয়-বৈষম্য পরিমাপের মানদণ্ড হলো গিনি কো-ইফিসিয়েন্ট। বর্তমানে এই সূচকে আমাদের অবস্থান দশমিক ৮ শতাংশ। এটা সর্বোচ্চ এবং ভয়ংকর। এর মানে হলো টাকা-পয়সা বড়দের হাতেই যায়।
তাই করোনাকালেও জিডিপি যতটুকু বেড়েছে তার সুফল বড়দের হাতেই চলে গেছে। অর্থাৎ দরিদ্রকে শোষণ করা হয়েছে। দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়,২০০৯ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ হাজার ৪৯২। এখন সংখ্যাটি ৮৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ গত ১১ বছরে দেশে কোটিপতি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬৪ হাজার।