করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় করণীয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন ২০২০ সালটি এক মহা মৃত্যুর মিছিল। দেশে অনেক প্রতিথযশা বুদ্বিজীবী ও প্রযুক্তিবিদ হারিয়ে গেছেন মৃত্যুর অতলে বৈশ্বিক মহামারী নোভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর সংক্রমণের কারণে। এই বছরে (২০২০) মার্চের ৪ তারিখে প্রথম বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যুর সংবাদটি আসে ১৮ মার্চ। এর পর থেকে দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে, যা ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দাঁড়ায় যাথাক্রমে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৮৬ এবং ৪ হাজার ৩৮৩ জন। বর্তমানে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম। এর ফলে মানুষের প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি, শিল্প, শিক্ষাসহ সকল সেবা খাতের অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ বার্ষিক ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। গত কয়েক মাসের গৃহবন্দী ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জীবনের অচলাবস্থার কারণে সকলের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার মাথাপিছু পরিমাণ ১১ হাজার ৩৪৩ টাকা, যা দিয়ে বাংলাদেশের একটি পরিবার দুই মাসে যে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করতে পারে তার মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, সবজি, ডাল, ডিম, পেঁয়াজ, দুধ, পাউরুটি ও ফলফলাদি। মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

কোভিড-১৯ মহামারীর সম্ভাব্য সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে, যা আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বলবত থাকবে। উল্লেখ্য যে, কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অর্থনীতির সকল কর্মকা-ে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা যেহেতু একটি সেবা খাত, এর ক্ষতি নিরূপণ করা এত সহজ হবে না অন্যান্য খাতের মতো। কিন্তু ইউনেস্কো বলেছে, নভেল করোনার কারণে বাংলাদেশের প্রায় ৪ কোটি বিভিন্ন স্থরের শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তারা আশা করছে। এ ছাড়াও ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাগণও এই ক্ষতির হুমকিতে রয়েছে।

প্রথমে আসা যাক শিক্ষার্থীদের বিষয় নিয়ে। যেখানে বাংলাদেশে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষার্থী ২ কোটি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী ৪ লাখ, মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী ১ কোটি, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী ৪০ লাখ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় স্মাতক ও স্মাতকোত্তর কলেজের শিক্ষার্থী ২৮ লাখ, সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৩৮ লাখ ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৫ লাখ (উৎস : হারুনার-রশীদ, উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়)। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সকল স্কুলে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক নির্বাহী আদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী (ইইসি), জুনিয়র ¯ু‹ল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা বাতিল করেছে সত্যি, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ভা- কতটুকু পূরণ হলো, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সবচাইতে বিপাকে পড়েছে বিশেষত যেগুলো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং স্কুল বন্ধ থাকায় টিউশন ফি দেয়া থেকে তারা বিরত রয়েছে যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে চাপ অব্যাহত রেখেছে।

এই দৈন্যতার কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে চাকরি থেকেও তাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছে কোন উপায় না পেয়ে। শিক্ষায় অর্থ যোগানের জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের ওপর নির্ভরশীল এবং করোনার কারণে দেশের ৩৫ শতাংশ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে, ব্যবসায়ীদের আয় কমেছে, অনেক বেসরকারী শিক্ষক চাকরি, টিউশনি, কোচিং সকলই হারিয়ে এখন প্রায় রাস্তায় বসেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তারা বলছেন শিক্ষার্থীর টিউশন ফি হলো তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। তা সময় মতো না পেলে স্কুলের প্রশাসনিক ব্যয় বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি করে। এখন আসা যাক সরকারী কাঠামোর শিক্ষকদের কথায়, যাদের কোন অস্তিত্বের সঙ্কট নেই এবং স্কুল বন্ধ থাকলেও বেতন-ভাতাদি সরকার যথানিয়মে বহন করছে যা সকল পর্যায়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার এখন জোরে সোরে চলছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ইউজিসির এর নির্দেশক্রমে বেশিরভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গত মে থেকে এবং সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পহেলা জুলাই থেকে প্রণোদনা ঘোষণা সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে অনলাইনে ক্লাস চালু করেছে- যার পদ্ধতিগুলো হলো জোম, গুগল, ফেসবুক। যার যার সুবিধামতো বেসরকারী কিংবা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্বল আইটি পরিকাঠামোর কারণে শিক্ষক/শিক্ষার্থী যে সকল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো হলো দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, নিম্নমানের ডিভাইস, ইন্টারনেটের মূল্য পরিশোধে অপারগতা ইত্যাদি। তাছাড়াও বিশেষ করে প্রাইমারী, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের যে সকল প্রতিষ্ঠান অনলাইন, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হয়েছে, সে জায়গায় দেখা গেছে অনেক শিক্ষার্থীর ই-মেইল এ্যাকাউন্ট, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন বা আইফোনর কোনটাই নেই, যা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বহির্প্রকাশ মাত্র।

এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীর মেধা কিংবা চরিত্র গঠনে কতটুকু সহায়ক হবে, সে প্রশ্ন নাইবা করলাম। এ প্রসঙ্গে সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বিল গেটস বলেছিলেন, দূরবর্তী শিক্ষার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এখন আসা যাক ব্যবহারিক ক্লাস নিয়ে বিশেষত চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি, রসায়ন, পদার্থ বিদ্যা ইত্যাদি, যা মূলত ল্যাবরেটরিভিত্তিক। সেসব অনলাইন পদ্ধতিতে কিভাবে হবে তা নীতিনির্ধারকদের বিষয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইউজিসি ল্যাব/ওয়ার্কশপভিত্তিক ক্লাসের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সম্মত নয়। তা হলে যারা এ সকল বিষয়ের শিক্ষার্থী তাদের প্রায় অর্ধেকেরই বেশি সিলেবাস মতে ব্যবহারিক ল্যাবভিত্তিক হলে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম কি অসম্পূর্ণ থাকবে না? এখন আসা যাক পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। সনাতনী প্রথায় ক্লাসভিত্তিক অভ্যস্ত নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে তা হঠাৎ করে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় বাড়িতে বসে হলে তা কতটুকু স্বচ্ছও নিরপেক্ষ হবে? শিক্ষা গবেষকগণ বলছেন প্রশ্নের ধারা পরিবর্তন করতে হবে, যাতে সৃজনশীলতাই পরীক্ষার একমাত্র নিয়ামক হয়।

কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেমন অর্থনীতি, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি যেখানে বই বহির্ভূত অন্য কিছুর সংযোজনের সুযোগ নেই। তা ছাড়া এই ধরনের একটি নতুন পদ্ধতিতে কোন কায়দায় কি প্রশ্ন করতে হবে, এ ব্যাপারে শিক্ষকদের আগ্রহ বা পারদর্শিতা কতটুকু তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পরীক্ষা শেষে উত্তরপত্র পাঠাতে পিডিএফ ফাইল তৈরি করতে হয়, যা অনেক শিক্ষার্থী জানে না। আবার যে সকল লেখা প্রিন্ট করে পাঠায় সেগুলো অস্পষ্ট থাকায় শিক্ষকের পক্ষে বিষয়বস্তু উদ্ঘাটন করে মূল্যায়ন করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে কারিগরি ত্রুটির কারণে উত্তরপত্র ই-মেইলে পাঠালেও তা শিক্ষকের কাছে পৌঁছায় না।

এখন আসা যাক আর্থিক বিষয় নিয়ে, যেখানে ছাত্র শিক্ষকের খরচের বিষয়টি জড়িত, বিশেষত ইন্টারনেটের জিপি ক্রয়ের বিষয়টি। হিসাব বলছে এই পদ্ধতিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের খরচ মাসে ন্যূনতম ২০০০ টাকা, যা অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের জন্য বহন করা কষ্টকর, যারা অনেকেই করোনার কারণে আয় সঙ্কোচনে পড়েছে বা চাকরি হারিয়ে পথে বসেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষা প্রশাসনে তার প্রভাবটা কি? যারা বর্তমান বছরে (২০২০) মাধ্যমিক পাস করেছে তাদের অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা কবে শুরু হবে তাও অনিশ্চিত। যার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্মাতক শ্রেণীতে ভর্তির একটা সংযোগ রয়েছে।

অর্থাৎ বিগত ছয় মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লকডাউনে থাকায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও উদ্যোক্তারা যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা পোষাতে সরকারের কি পরিকল্পনা রয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু যে শিক্ষক পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছে কিংবা যে উদ্যোক্তা তার ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে সরকারেরই বা করণীয় কি? সেই সকল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শিক্ষার্থীও রয়েছে। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, করোনার পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হবে না এবং প্রয়োজনে নবেম্বর মাসে স্কুলে অটোপ্রমোশনের ব্যবস্থা করা হতে পারে, যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়। যদি সরকারের অবস্থান তাই হয় তবে জীবন জীবিকার তাগিদে যখন অর্থনীতির সকল খাত খুলে দেয়া হয়েছে তা হলে বেসরকারী শিক্ষকতার পেশায় জড়িত লোকদের জীবিকায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে কেন?

আজ যারা প্রাথমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করছে তাদের ভেতর থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা ১০-১৫ বছর পর উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হবে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের ভিত যদি দুর্বল হয় তবে জাতির ভিত্তি মজবুত হবে কি করে। শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো, সার্বিক আয়োজনটি হয়ে গেছে পরীক্ষা কেন্দ্রিক, জ্ঞানভিত্তিক নয়। এই প্রতিযোগিতায় ভাল গ্রেড পাওয়াই মূল লক্ষ্য, যার জন্য যা কিছু করা দরকার সেটাই চলছে বৈধ কিংবা অবৈধ যে পথেই হোক না কেন। ফলে শিক্ষার্থীর তুলনায় অভিভাবকদের বেশি তৎপর হতে দেখা যায় শিক্ষার্থীর মতামতকে উপেক্ষা করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে পরীক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য সত্যি। কিন্তু সেটি কিভাবে হবে সে সম্পর্কে প্রথম গবেষণাটি করেছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ জে হাটগ।

তিনি সারা ভারতবর্ষ ঘুরে যে গবেষণাপত্রটি তৈরি করেছিলেন তা সারা কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এই গবেষণার প্রায়োগিক ফলাফল নিয়ে কেউ কিছু করতে পেরেছিলেন কিনা, তা আর জানা যায়নি। জর্জ বার্নার্ড শ তার ম্যান এ্যান্ড সুপারম্যান নাটকে একটি চরিত্রের মাধ্যমে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলেছিলেন, যে পারে সে করে, আর যে পারে না সে হয় শিক্ষক। শিক্ষকদের সক্ষমতা নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য আমাদের সমাজে নতুন নয়। তার পরও সমাজের নানান পরিবর্তন সত্ত্বেও শিক্ষকের একটি ভূমিকা সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যায়নি। শিক্ষক এখনও মানুষ গড়ার কারিগর এবং বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাঝে নেতৃত্ব সৃষ্টির দায়িত্ব শিক্ষকদের, যা সমাজের আরও দশটি পেশা থেকে ভিন্ন। যদিও সমাজ সেটি উপলব্ধি করতে পারছে না, যার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে।

এখন আসা যাক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে পাবলিক সেন্টিমেন্ট কি এবং এর সঙ্গে সরকারের অবস্থান কি? বছরের শেষ প্রান্তে এসে শিক্ষায় সেসন জট কিভাবে নিরসন হবে? এও শোনা যাাচ্ছে ৪ অক্টোবর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া ঠিক হবে কি না? শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে পরবর্তী শ্রেণীতে অটোপ্রমোশন দেয়াও ঠিক হবে কিনা? এ ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া মিশ্র, যা দুই মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্বচ্ছ হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, একটি বছর ছেলেমেয়েরা না পড়লে মূর্খ হবে না, কিন্তু করোনায় সংক্রমিত হলে বহু মায়ের বুক খালি হবে। এ উক্তি থেকে পরিষ্কার যে, সরকার অন্তত এ বছরটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে নয়। আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেছেন অটোপ্রমোশনের কথা।

বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য ঝুঁকিকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে এই কারণে যে, প্রতিদিনই দেশের মিডিয়াগুলো বৈশ্বিক বনাম বাংলাদেশের সংক্রমণ, সুস্থতা ও মৃত্যুর হার প্রচার করে চলেছে, যার সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ইমেজ জড়িত রয়েছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, উদ্যোক্তা- এই চারটি স্টেকহোল্ডার যারা বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত তাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে আন্দোলনের পথ বেছে নেবে কি? এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অভিভুক্ত কলেজসমূহের শিক্ষার্থীরা তাদের স্মাতক (সম্মান) ও স্মাতকোত্তর পরীক্ষা বিলম্বের কারণে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, যা কাম্য নয়। এখন সরকারের সামনে কতগুলো বিকল্প সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে, যেমন-

এক : অতি দ্রুত বেসরকারী-সরকারী পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ছাত্র-শিক্ষক সবাই যার যার ক্লাসে উপস্থিত থাকবে। যদি অবস্থার সত্যি সত্যি উন্নতি হয় ভাল, আর যদি না হয় তবে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে;

দুই : বিগত আট মাসে বেসরকারী খাতের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উদ্যোক্তা ও শিক্ষকগণ যে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে, তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করতে পারে সঙ্কটকালীন সময়ের জন্য, যেমনটি সরকার অন্যান্য খাতের জন্য করেছে-

তৃতীয়ত: উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে এই কারণে যে, শিক্ষা কোন পণ্য নয়, এটি একটি সেবা খাত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ ধারাটি লঙ্ঘনের আলামত পাওয়া যাচ্ছে যা সবাই জানেন। দুর্যোগ কখন আসবে কেউ জানে না। যার জন্য বার্ষিক লভ্যাংশ থেকে আপৎকালীন ফান্ড গঠন করা সময়ের দাবি;

চতুর্থত: আমরা ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে উন্নত দেশগুলো মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রস্তুত নয়। যার ফলে সারা বিশ্ব উন্নত-অনুন্নত সকলই কোভিড-১৯ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। আমেরিকাতেই মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে এবং এই পরিস্থিতি মোকারেলায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে;

পঞ্চমত: করোনাকালের শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর নিয়ে দেশের মধ্যে কেউ ভাবছে কিনা তা বোঝা দুষ্কর। কারণ সরকার প্রথম থেকেই একলা চলা নীতিতে চলছে, যদিও এটি একটি জাতীয় সমস্যা। সরকার এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারে।।

ষষ্ঠত : করোনা মোকাবেলায় কেরালা মডেল থেকে ধারণা নেয়া যেতে পারে, বিশেষত তারা তাদের শিক্ষা সঙ্কট করোনাকালে কিভাবে মোকাবেলা করেছে।

সবশেষে বলা যায়, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কবে অবসান হবে তা এই মুহূর্তে বলা যায় না। অর্থনীতিসহ জীবন-জীবিকার ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে সরকারের উদ্যোগের কোন ঘাটতি নেই। এই পর্যায়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক, নীতিনির্ধারকবৃন্দ সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেবেন এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যে আর্থিক দুর্বলতা করোনার কারণে সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আবার শিক্ষার্থীদের কলকাকলীতে ক্যাম্পাস মুখরিত হোক, সেই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : ড. মিহির কুমার রায়, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন ও অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটির, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.019439935684204