করোনায় মৃত্যু ৫ হাজার, তবুও কি আমরা উদাসীন থাকব? - দৈনিকশিক্ষা

করোনায় মৃত্যু ৫ হাজার, তবুও কি আমরা উদাসীন থাকব?

আমিরুল আলম খান |

আমি যখন এই নিবন্ধ লিখতে শুরু করছি তখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮১২ জন। আর মারা গেছেন ৪ হাজার ৯৮৪ জন। ১২৭টি দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছে ( সূত্র : worldmeter.info)। আমি জানি না, লেখা শেষ হতে হতে নতুন আর কোনো দেশে তা হানা দেবে কি না; আর ততক্ষণে সংক্রমিত ও মৃত্যুর সংখ্যা কতটা বাড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বের সকল মানুষকে এখনই সক্রিয় হতে আহ্বান জানিয়েছে।

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে এখন অবস্থার নাটকীয় উন্নতি ঘটেছে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংহার মূর্তি ধারণ করেছে ইউরোপে। ইতালিতে তা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। সেখানে সংক্রমণ ঘটছে অতি দ্রুত, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ঠিক এই মুহূর্তে ইতালিতে সংক্রমিত ১৫ হাজার ১১৩, মারা গেছে ১ হাজার ১৬ জন। এশিয়ায় চীনের পরই ইরানে করোনা ভাইরাস সর্বগ্রাসী রূপে হানা দেয়। সেখানে সংক্রমিত হয় ১০ হাজার ৭৫ জন, মারা গেছে ৪২৯ জন। প্রথম ধাক্কায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া খুব সাফল্যের সাথে তা মোকাবেলা করে। সেখানে মৃত্যু হার মাত্র শূন্য দশমিক ৭২।

ইতালিতে মৃতের হার সবচেয়ে বেশি, ৫ শতাংশ। স্পেনে ২ দশমিক ৪৩, ফ্রান্সে ২ দশমিক ১২ শতাংশ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সবচেয়ে উন্নত দেশও টালমাটাল। যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের হার ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, যেখানে চীনে ৩ দশমিক ৮৮, ইরানে ৩, জাপানে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। 

ইউরোপের উন্নত দেশসমূহে এমন দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে তা বোধহয় কেউ ভাবেননি। জার্মান, ফ্রান্স, রাশিয়া, স্পেন, গ্রেট ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও অন্যান্য উন্নত দেশ দ্রুতই করোনা ভাইরাসের কবলে পড়ে। শুধু তাই নয়, এই ভাইরাস আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে হানা দেয় দুই আমেরিকা মহাদেশে এবং অস্ট্রেলিয়ায়। বলা হয় দুনিয়ায়
সবচেয়ে উন্নত ও সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে কিউবা। সেখানে হাত বাড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছেন।

ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্প আক্রান্ত কি না তা পরীক্ষা করাতে দেননি। ট্রাম্পের এই একগুঁয়েমি সারা দুনিয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে।

আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, গত আড়াই মাসে করোনা ভাইরাস ৩৮০ বার তার জিন বদলে ফেলেছে। কোনো ভাইরাসের বেলায় এটা একটা নজিরবিহীন ঘটনা। জার্মানীর ৭০ ভাগ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, এমন আশঙ্কা খোদ জার্মান চ্যাঞ্চেলর আঙ্গেলা মার্কেলের।

আমরা লক্ষ্য করেছি, সৌদি আরবে করোনা রোগী পাওয়া গেছে, কিন্তু কেউ মারা যায়নি। কিন্তু সম্ভাব্য দুর্যোগ এড়াতে সেদেশে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, ওমরাহ ভিসা দেয়া হচ্ছে না। এমন কি, মক্কার বাসিন্দাদেরও ওমরাহ পালনের অনুমতি দিচ্ছে না। হয়তো এ বছর হজও বন্ধ হতে পারে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং আরব দেশগুলোতে করোনা হানা দিলেও সে সংখ্যা যেমন কম, তেমনি প্রাণহানিও কম। সার্ক দেশগুলোর মধ্যে কেবল ভারতে একজন গতকাল মারা গেছে। সেখানে আক্রান্ত ৭৫ জন। পাকিস্তান (২১), শ্রীলঙ্কা (৩), বাংলাদেশ (৩), নেপাল (১), ভূটান (১), মালদ্বীপ (৮) করোনা রোগী শনাক্ত হলেও কেউ মারা যায়নি।

দুনিয়ার কোনো দেশই স্বস্তিতে নেই। করোনার প্রাদুর্ভাব এড়াতে সবদেশেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গণপরিবহনে জারি করা হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। চার্চে না যেতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বাতিল বা স্থগিত করা বড় বড় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সেমিনার। দর্শক শূন্য স্টেডিয়ামে কিছু খেলা এখনো চলছে বটে; কিন্তু অবস্থার নাটকীয় উন্নতি না হলে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজধানী ওয়াশিংটন, বাণিজ্য শহর নিউইয়র্কসহ বহু এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। ইউরোপের ২৭টি দেশের নাগরিকদের আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ৩০ দিনের জন্য সব ভ্রমণ ভিসা বাতিল। ভারতও সব দেশের নাগরিকদের সব ধরনের ভিসা আগামী মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করেছে। রাজধানী দিল্লির সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। দুনিয়া জুড়ে বিমানের উড়াল নেমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। তাও কতক্ষণ চালু থাকবে বলা কঠিন।

গত ১২ মার্চ বিবিসি বলেছে গত দু’ মাসে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে এসেছে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক মানুষই রয়ে গেছে নজরদারির বাইরে। বিমানবন্দরে তাদের যথেষ্ট থার্মাল স্ক্যানিংও হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বারবার সতর্ক করে আসছে। কিন্তু যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় মেলা চলছে। গণপরিবহনে আগের মতোই ঠাসাঠাসি করে মানুষ ছুটছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চলছে আগের মতোই। যেন দুনিয়ার কোথাও কিছুই ঘটেনি, ঘটছে না। তবে কি আমরা দুটো তত্ত্বে আস্থাশীল হয়ে পড়েছি? ১. গরমে করোনা ভাইরাস নিজেই শায়েস্তা হয়ে যাবে। ২. বিষে বিষে নীলকণ্ঠ বাঙালির ইমিউনিটি এতই বেশি যে করোনা ভাইরাস এখানে কিছুই করতে পারবে না!

উদাসীন জাতি হিসেবে অবশ্য আমাদের খ্যাতি আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যুদ্ধ যুদ্ধ তামাশা করে উপমহাদেশে বাংলায়ই প্রথম শাসন কায়েম করেছিল। কোনো বাঙালি প্রতিরোধ করেনি। বরং কলকাতায় ধনী বাঙালিরা পাল্লা দিয়ে কোম্পানির শাসনে-শোষণে মদদ দিয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর একে একে এর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, খাদ্য শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলেছে একটি গোষ্ঠী কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই। আদমজি পাটকল খুচরো যন্ত্রপাতির মতো লুটে নিয়েছে, কেউ বাধা দেয়নি। পথে পথে প্রতিদিন শত শত মানুষ দুর্ঘটনায় মারা পড়ছে, চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা হচ্ছে, তাতে শাসকদের কিছুই আসে যায় না। ভেঙে ফেলছে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা; তাতে কি? বিষাক্ত আর ভেজাল খাবারে দেশের মানুষ নানা দুরারোগ্য রোগে ধুকে ধুকে মরছে। তার কার কী আসে যায়? বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার চলে যায়। কোনো টুঁ শব্দটি নেই। সবগুলো ব্যাংক প্রায় দেউলিয়া হতে চলেছে, তাতেও কারো ঘুম নষ্ট হয় না। মশার জ্বালায় মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত সিটি কর্পোরেশন নাক ডাকিয়ে ঘুমায়। ডেঙ্গুতে মানুষ মরলেও কোনো শিক্ষা নেয় না কেউ। কৃষক ধানের আবাদ করে সে ধান বিক্রি করে শুধু ধান কাটার খরচ তুলতে পারে না, সবাই নির্বিকার থাকে। আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরে যায়, নির্বাচন কমিশন তাতে বেআইনি কিছু খুঁজে পায় না।

সরকার শুধু বলছে, যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তারা যেন ১৪ দিন সেল্ফ কোয়ারান্টাইন করেন। এই স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্ন জীবন তাদের আশঙ্কামুক্ত রাখতে যথেষ্ট এমনই একটা গা-ছাড়া ভাব সরকারের। যে কোনো বিবেচনায় এটি মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। মেলা চলতে দেয়া, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চালু রেখে আমরা কোন অনর্থকে ডেকে আনছি কে জানে? বিচ্ছিন্ন করা ছাড়া করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় না থাকে, তাহলে তৎপর হবার এখনই সময়। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।

লেখা যখন শেষ করছি তখন দুনিয়ায় মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪৩ আর মৃত্যু সংখ্যা ৪ হাজার ৯৯৫ জনে (worldmeter.info)। মাত্র দু’ ঘণ্টায় লাফ দিয়ে বেড়ে গেছে অঙ্কটা। তবুও কি আমরা উদাসীন থাকব?

লেখক : আমিরুল আলম খান, শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান যশোর শিক্ষা বোর্ড।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037398338317871