ইতালি, স্পেনের পর করোনাভাইরাসের মহামারীর নতুন কেন্দ্র হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে বুধবার ১০৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মারা গেছে ৫২২ জন। দেশটিতে মোট ৫ হাজার ৬২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশটিতে এ পর্যন্ত করোনায় ৫৩ প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন। আক্রান্তের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন পৃথিবীর শীর্ষে- এ সংখ্যা দুই লাখ ৩৫ হাজার ৭৪৭ জন। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির হাসপাতাল ও অন্য সেবা সংস্থাগুলো।
কেন্দ্রীয় সরকারের মজুদে থাকা সুরক্ষা সরঞ্জাম ও চিকিৎসা উপকরণও প্রায় শেষ দিকে। সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ মহামারীতে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ইতালি। আমাদের অবস্থার সঙ্গে শুধু ইতালির তুলনাই চলে।
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৯৩৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ৫১ হাজার ৩৭৫ জনের। আর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ২ লাখ ১০ হাজার ২৪৪ জন। ইউরোপের দেশ স্পেনে প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে।
দেশটিতে বৃহস্পতিবার ৭০৯ জন এবং বুধবার ৯২৩ জনের প্রাণ গেছে। ইতালিতে বৃহস্পতিবার ৭৬০ জন এবং বুধবার ৭২৭ জন মারা গেছেন। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ১৩ হাজার ৯১৫ জন। ফ্রান্সে বৃহস্পতিবার ৪৭১ জন এবং বুধবার ৫০৯ জন মারা গেছে। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৫০৩ জন, বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে ৫৬৯ জন মারা গেছে। দেশটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯২১ জনে।
মহামারীর বিপজ্জনক এ রূপ দেখে নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলার নীতিমালায় পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস। জেনেভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, এটা এখনও আমাদের কাছে নতুন একটি ভাইরাস এবং আমরা শিখছি প্রতিনিয়ত। যেহেতু অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে, নতুন তথ্য আসছে, তাতে আমাদের পরামর্শও বদলাবে।
১ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে হাতে গোনা কয়েকজন হলেও ১ মাসের ব্যবধানে এ সংখ্যা এখন ২,৩৫,৭৪৭ জন। মোট মৃত্যু হয়েছে ৫১৩২ জনের। সুস্থ হয়েছেন ১০,৩২৪ জন। বুধবার ২৪ ঘণ্টায়ই দেশটিতে রেকর্ড ১০৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে কানেকটিকাটের ৬ সপ্তাহের একটি শিশুও আছে। এটিই দেশটিতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত সবচেয়ে কম বয়সী কারও মৃত্যু বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে শুধু বুধবারই ২৫ হাজারের বেশি মানুষের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে নিউইয়র্কের অবস্থাই সবচেয়ে ভয়াবহ; শহরটিতে একদিনেই এক হাজার তিনশ’র বেশি মানুষ মারা গেছেন।
শহরটির হাসপাতালগুলোর বাইরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাক বোঝাই অসংখ্য মৃতদেহ দেখা গেছে। নিউ অরলিয়ন্স ও ডেট্রয়টেও আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। ফ্লোরিডা, জর্জিয়া ও মিসিসিপিতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে দেশটির ৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীই এখন লকডাউন বা ঘরবন্দি দশায় আছেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, এ মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের মজুদে থাকা সুরক্ষা সরঞ্জাম ও চিকিৎসা উপকরণও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আশ্বস্ত করে বলেছে, তারা পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে এবং এ জন্য আরও এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের তহবিল রয়েছে। রাশিয়া থেকেও বেশকিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম এসেছে।
ভারতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। দেশটিতে বৃহস্পতিবার ১০ জন এবং বুধবার ২৩ জন মারা গেছে। মোট মৃত্যু ৬৮। বৃহস্পতিবার ৩৪৩ জন এবং বুধবার ৬০১ জন আক্রান্ত হয়েছে। দেশটিতে মোট আক্রান্ত ২,২৪১ জন।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের সতর্কবাণী : ইতালির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের করোনা পরিস্থিতির মিল রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউস করোনা মহামারীর এক মডেল উন্মোচন করে। ওই মডেলে বলা হয়েছে, কঠোর এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হলেও এই ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
ওই মডেলের দিকে ইঙ্গিত করে মাইক পেন্স সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ মডেলের সঙ্গে শুধু ইতালির তুলনাই চলে। এ মহামারীতে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ইতালি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও হয়েছে সেখানে। মহামারী নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। একই পরিণতি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের কাছে জরুরি সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর এবং স্থানীয় কর্মকর্তারা।
করোনা ধাঁধার সমাধান মিলবে পরীক্ষায় : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে- যদি করোনা ধাঁধার উত্তর পাওয়া যায়। তিনি বলেন, যদি সত্যিই করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে হয়; তাহলে করোনা কিট দিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে।
অর্থাৎ যত বেশিসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা যাবে, মুক্তি মিলবে তত দ্রুত। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৫০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার জনের করোনা পরীক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। পরীক্ষা সক্ষমতা ব্যাপক হারে বাড়ানো দরকার। ফলে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী পরীক্ষা না করেই নিজে আইসোলেশনে আছেন, তারা করোনা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের সেবা করতে পারতেন।
চারটি ওষুধ নিয়ে কাজ চলছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস বলেছেন, নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সব মিলিয়ে ৪টি ওষুধ ও কয়েকটি ওষুধের সমন্বিত প্রয়োগ নিয়ে কাজ চলছে। বুধবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য সব দেশকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তিনি আরও বলেন, সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৭৪টি দেশ এই কাজে অংশ নিয়েছে বা অংশ নেয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। ২০০-র বেশি রোগীকে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কোনো ওষুধ কার্যকর হবে, সেটি জানতে প্রত্যেক রোগীই আমাদের সহায়তা করছেন। আমাদের এক ধাপ করে এগিয়ে দিচ্ছেন। উন্নয়নশীল দেশের ঋণ মওকুফেরও আহ্বান জানান তিনি।
৫৩ বাংলাদেশির মৃত্যু : যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ দিনে ৫৩ প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১৮ জন। করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া লোকজনকে আত্মীয়স্বজনরা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় সমাহিত করছেন। নিউইয়র্কে মারা যাওয়া বেশ কয়েকজনের অন্তিম ঠিকানা হয়েছে নগরীর ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল কবরস্থানে।
তবে বাংলাদেশিদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা বা বাড়িতেই সুস্থ হচ্ছেন এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, নিউইয়র্ক প্রবাসী আবু জাফর (৬২) বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি উল্লাপাড়া পৌর শহরের শ্রীকোলা মহল্লার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে। তার বড় ভাই নিউইয়র্ক প্রবাসী হযরত আলী (৭০) করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্যদিকে বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেনাপোলের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান (৭০) মারা গেছেন। বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় নিউইয়র্ক শহরের একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি।