করোনায় শিক্ষকদের সঙ্গে এমন কোরোনা - দৈনিকশিক্ষা

করোনায় শিক্ষকদের সঙ্গে এমন কোরোনা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

করোনা দুর্যোগে সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষক-কর্মচারীকে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ সহায়তা তহবিলে একদিনের বেতন দেবার সুযোগ করে দেয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাতে হয়। জাতির যে কোনো দুর্যোগে শিক্ষক সমাজ অতীতের ন্যায় বর্তমান করোনা মহামারিতে পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবার একটি আনুষ্ঠানিক সুযোগ পেয়েছেন। শিক্ষক দেশ ও জাতি তথা সমাজের পরম বন্ধু। সেই সত্যকে ধারণ করে শিক্ষকতার মহান ব্রতে তারা নিয়োজিত আছেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন দিনগুলোতে দেশের শিক্ষক সমাজ পীড়িত মানুষজনের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনার দুর্দিনে তারা দেশবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিশ্বাস করেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।

এবার করোনার এই দুঃসময়ে একদিনের বেতন দেবার সুযোগ পেয়ে সকল শিক্ষক আনন্দিত হয়েছেন। নিজেদের সীমিত আয় থেকে আর্তমানবতার সেবায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে বাধিত হয়েছেন। অনেক শিক্ষক আগে থেকেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়ে আসছিলেন। আর্তপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে তাদের কোনো কার্পণ্য নেই। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের একদিনের বেতন দেবার কথা বলা হয়, তাতে শিক্ষকদের স্বস্তির চেয়ে দুর্গতি বেশি হয়ে যায়। অতীতে বন্যা, সাইক্লোন, সিডর ইত্যাদি দুর্যোগে শিক্ষকদের একদিনের বেতন ব্যাংকে কেটে রাখা হতো। সেভাবে বেতন বিল করে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ব্যাংকে জমা দিতেন। তাতে কোনোদিন একটুও কারো গায়ে লাগেনি। কিন্তু এবার জমা দেবার প্রক্রিয়াটি করোনা মহামারির এই কঠিন সময়ে নানা কারণে শিক্ষকদের জন্য কঠিনতর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য তা কষ্টের বিষয় হয়ে ওঠে। আর বরাবরের মতোই শিক্ষকদের এ কষ্টের কথা উঠে আসে শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদনে। 

স্মরণকালের ভয়াবহ মানবিক সংকটে লকডাউন বলি আর যাই বলি, সেটি শুরু হওয়ার পর বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষকই আজ পর্যন্ত কোনো বেতন পাননি। সাধারণ স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের মার্চের বেতন তুলনামূলক দেরিতে ছাড় হয়েছে। বৈশাখি ভাতা আরও বিলম্বে। আজ পর্যন্ত ব্যাংকে আসেনি। আগামী ১২ এপ্রিল মার্চের বেতন তোলার শেষ তারিখ। এই দুর্দিনে মার্চ মাসের বেতন ৩০ তারিখের আগে ছাড় দিয়ে এপ্রিলের ২/৩ তারিখের মধ্যে উত্তোলনের সুযোগ দেয়া যেত। একই সাথে বৈশাখি ভাতা ছাড় করা যেত। যারা বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ভাতা ছাড় করে, করোনার দুঃসময়েও তাদের এতটুকু করুণা হয় না। বরাবরের মতো বেসরকারি শিক্ষকদের কষ্ট দিয়ে তারা আনন্দ পায়! এই দুর্দিনে তারা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে উত্তোলনের সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে। তদুপরি ব্যাংকগুলোর স্বভাব এই যে, এরা শেষ তারিখের আগে বিল জমা নেয় না। জমা নিলেও টাকা দেয় না। মনে হয় এরা বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়তি ঝামেলা মনে করে।

প্রসঙ্গত, কোনও পরিকল্পনা না থাকলেও বাধ্য হয়ে এবার সর্বপ্রথম মাউশি অধিদপ্তর অনলাইনে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের এমপিও পাঠিয়েছে। সবাই যার যার ঘরে বসে অনলাইন থেকে সেটি বের করতে পেরেছেন। তবে, স্মারক নং পেতে দেরি হয়েছে। আগে এমপিও নিয়ে ব্যাংকের লোকজন শিক্ষকদের কম ঘুরায়নি। মুখ কালাকালি কম করেনি। আজ আসে নাই, কাল আসবে- করে করে হয়রানি করে তৃপ্তির ঢেকুর গিলতো। এবার সেটির অবসান হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও  মাউশিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা দেই, তারা অন্তত ব্যাংকের লোকজনের একটি বিরক্তি ও উষ্মা থেকে এই দুর্দিনে বেসরকারি শিক্ষকদের মুক্তি দিয়েছে।

বেসরকারি শিক্ষকদের মার্চ মাসের বেতনের টাকা থেকে করোনা মহামারি সংক্রমণ রোধে আর্থিক সহায়তা কেটে নেয়া যেত। এখন সবার ঘরে থাকার সময়। টাকা দেবার জন্য ঘর থেকে বাইরে যাবার প্রয়োজন পড়তো না। কিন্তু তা না করে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকের একদিনের বেতন একত্র করে মাউশির ডিজি সাহেবের একাউন্টে জমা দেবার কথা বলা হয়। আতঙ্কের এই দুর্যোগময় দিনে শিক্ষকেরা বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের বাড়িঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। দূর-দূরান্তের শিক্ষকেরা পরিবার পরিজনের মায়ায় বাড়িঘরে চলে গেছেন। কেউ টাঙ্গাইল, কেউ রাজবাড়ি। কেউ ময়মনসিংহ কেউ সুনামগঞ্জ। বিকাশ-নগদ-রকেটের অধিকাংশ ঘর বন্ধ। ব্যাংক সীমিত আকারে চলে। ছাত্র বেতন আদায় না হওয়া দ্বিতীয় মাসে গড়ালো। প্রতিষ্ঠানে তহবিলের অবস্থা ভালো নেই। এই সময়ে সব শিক্ষক-কর্মচারীর একদিনের বেতন এক জায়গায় একত্র করে ব্যাংকে জমা দেয়া এক কঠিন কাজ। প্রতিষ্ঠানের ক্যাচমেন্ট এলাকায় যেসব শিক্ষক-কর্মচারী আছেন, তারা সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাড়ি-ঘরে অবস্থান করছেন। অতি প্রয়োজন না হলে বাইরে যাচ্ছেন না। এই অবস্থায় বাইরে বের না হয়ে ত্রাণ তহবিলে কী করে একদিনের বেতন জমা দেবেন? ১২ তারিখের পরের কোনো তারিখ হলে সুবিধা একটু ভালো হতো। শিক্ষকেরা বেতন তোলে ত্রাণ তহবিলে দিতে কোনো বেগ পেতেন না।

মাউশি থেকে এ বিষয়ে ৭ এপ্রিল সার্কুলার জারি করে ৯ এপ্রিল প্রদানের শেষ সীমা বেঁধে দেয়া হয়। মহাপরিচালকের যে একাউন্টে টাকা জমা হবে, সেটি অগ্রণী ব্যাংকের। অন্য কোনো ব্যাংকে জমা দেবার সুযোগ নেই। আতঙ্কের মধ্যে এত অল্প সময়ে বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মচারী ঘরে থেকে এই সার্কুলারটি জানতে পারেননি। যেটুকু জানতে পেরেছে দৈনিক শিক্ষার কল্যাণে। অগ্রণী ব্যাংক যেখানে সেখানে নেই। ব্যাংকের শাখা আশেপাশে না থাকার কারণেও অনেকে ত্রাণ তহবিলে টাকা দিতে পারেননি। অনেকে জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে ইচ্ছে থাকা সত্বেও অংশ নিতে পারেননি। 

সার্কুলারে আগ্রহী শিক্ষকদের একদিনের বেতন জমা দিতে বলা হয়েছে। এটা নিছক ভদ্রতা। অনুদান তো জোর করে হয় না। আর বিষয়টি সম্মানিত শিক্ষকদের তাই হয়তো ওভাবে আদেশ করা হয়েছে। তবে, শিক্ষকদের একটি অংশ এমন আদেশের সমালোচনাও করেছেন। মাদরাসা ও কারিগরি অধিদপ্তর ২৫ মার্চ চেক ছাড় করতে পারলে  মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর কেন পারেনি। এটি অধিদপ্তরের আমলাদের উদাসীনতা এবং কারসাজি বলেও প্রশ্ন তুলেছেন।  বেসরকারি শিক্ষকদের বিতর্কিত ও কষ্ট দেয়ার জন্য বরাবরের মতো এই সংকটের দিনেও তারা সক্রিয় থেকেছে। করোনার এই সংকটময় দিনেও শিক্ষকদের প্রতি তাদের এতটুকু করুণা হয় না।

প্রকৃতপক্ষে, বেসরকারি সব শিক্ষক-কর্মচারী একদিনের বেতন সরকারি ত্রাণ তহবিলে দিতে রাজি আছেন। দেবার সুযোগ যারা পাননি, তাদের আগ্রহ নেই এমন বলা কি ঠিক হবে? আবার সংকটের এই মুহূর্তে কারো হাতে নগদ টাকা না থাকার কারণে দিতে না পারলে তিনিও কি আগ্রহী নন? যারা আশেপাশে অগ্রণী ব্যাংক না পেয়ে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও করোনা তহবিলে একদিনের বেতন জমা দিতে পারেননি, তারাও কি আগ্রহী নয়? বেসরকারি সব শিক্ষক-কর্মচারী জাতির যে কোনো দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতে বরাবর আগ্রহী থাকেন। করোনার এই দুর্যোগময় দিনে যেসব শিক্ষক-কর্মচারী বেতনের টাকা করোনা সংক্রমণ রোধের জন্য সহায়তা তহবিলে জমা দিতে পারেন নাই, তাদের জন্য নতুন করে একটা বর্ধিত সময় দেয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে যে কোনো দুর্যোগের সময় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেবার কথা না বলে সোজা বেতন থেকে কেটে নিলে কেউ কোনো আপত্তি করবেনা। অতীতে এ নিয়ে কেউ কোনোদিন আপত্তি করেনি। এবার যেটুকু আপত্তি সে কেবল নগদ টাকা জমিয়ে একটি নির্দিষ্ট  ব্যাংকের আরেক নির্দিষ্ট একাউন্টে জমা দেয়া। সেই সাথে স্বল্প সময়ের সার্কুলারে হাত খালি অবস্থায় বেতন না পেয়ে একদিনের বেতন দেয়া। এই দুঃসময়ে মহৎ কাজটি করতে গিয়ে অনেকে করতে পারেননি। অনেককে কষ্ট করে কাজটি করতে হয়েছে।

যারা শিক্ষকদের নানা কাজ করার আদেশ নির্দেশ দিয়ে সার্কুলার দেন, তাদেরকে বলি-দয়া করে যে কোনো সার্কুলার দেবার সময় সেটি ভেবে চিন্তে দেবেন। নিজে না পড়ে কেবল কেরানি সাহেবের তৈরি করা সার্কুলারটি সই করে ছেড়ে দেবেন না। শিক্ষকেরা করোনার কারণে বাড়িঘরে থেকে মনের শান্তিতে নেই। প্রিয় শিক্ষার্থী, সহকর্মী আর প্রিয় শ্রেণিকক্ষ থেকে দূরে থেকে তারা আজ বড় কষ্টে আছেন। সুখে আছেন মনে করে কেউ তাদের সুখটুকু নষ্ট করার জন্য এমন সার্কুলার দিয়ে থাকতে পারে। যারা সার্কুলার ছাড়েন তাদের বলি- প্লিজ, করোনায় শিক্ষকদের সাথে আর কোনোদিন এমন করোনা। শিক্ষকদের কষ্ট দিয়ে কেউ কোনোদিন শান্তি পায়নি। করোনার কারণে আজ কারো মনে শান্তি নেই।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069801807403564