কর্মকর্তাদের আশ্বাস ও প্রাথমিকের শিক্ষকদের দীর্ঘশ্বাস - দৈনিকশিক্ষা

কর্মকর্তাদের আশ্বাস ও প্রাথমিকের শিক্ষকদের দীর্ঘশ্বাস

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের বেতন বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনে আমাকে ও লালবাগ থানার শিক্ষক নেতা সেলিমুজ্জামানকে জেল হাজতে যেতে হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, সে অনুষ্ঠানে আমরা বেতন বৈষম্য দূরীকরণের প্রচারপত্র বিলি করেছিলাম।

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যদের হাতে অনুষ্ঠানস্থল থেকে আমরা গ্রেফতার হই। সারাদেশে শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে বেশি সময় আমাদের কারাবাস করতে হয়নি। বিভিন্ন সংবাদপত্রে গ্রেফতারের সংবাদটি শীর্ষে স্থান পায়। তখন ইলেকট্রনিক, অনলাইন ও ফেসবুক প্রচার ছিল না বললেই চলে।

আমাদের গ্রেফতারে শিক্ষকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ, বেতন বৈষম্য দূরীকরণ আন্দোলন বিশেষ মাত্রা যোগ হয়। সে সময়ের প্রধান বৈষম্য ছিল ননট্রেইন্ড উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকেরা ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর সমতুল্য বেতন পেত। সে আন্দোলনে প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষকেরা ২৬০০ টাকা বেতন স্কেল থেকে ৩০০০ টাকা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকেরা ৩০০০ টাকা স্কেল থেকে ৩১০০ টাকা স্কেলে, প্রধান শিক্ষকের ৩৩০০ টাকার স্কেল ৩৭০০ টাকায় উন্নীত হয়। সে সময় মুক্তাঙ্গনে বিশাল অনশনে শিক্ষকেরা অপেক্ষায় ছিলেন সরকারের প্রতিনিধিরা এসে অনশন ভাঙ্গাবেন এবং ঘোষণা দিবেন। শিক্ষকদের মাঝে ক্ষোভের পাশাপাশি চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হারিছ চৌধুরী অনশনস্থল মুক্তাঙ্গনে না এসে শিক্ষক নেতাদের সচিবালয়ে ডেকে সেসময় বৈষম্য দূর করার ঘোষণা দিলেন।

বর্তমান বেতন বৈষম্য হলো, প্রধান শিক্ষকের পরের স্কেল সহকারীদের উন্নীত করা। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সহকারী শিক্ষকদের মাঝে ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। তৎকালীন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি যথাযথ ও যথাসময়ে সহকারী শিক্ষকদের ক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে নিয়ে এগিয়ে না আসায় যত্রযত্র সহকারী শিক্ষকদের অসংখ্য সংগঠন গড়ে ওঠে। অপরদিকে ২য় শ্রেণির মর্যাদা পেয়ে প্রধান শিক্ষকদের মাঝে অহমিকা মনোভাব সৃষ্টি হয়ে প্রধান শিক্ষক সমিতি গড়ে ওঠে। সেখানে ঐক্যবদ্ধভাবে সকল শিক্ষক পরস্পরের সুখ-দুঃখ যন্ত্রণার সাথী হয়ে একে অপরের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়বে, তাদের সে মমত্ববোধটুকু হারিয়ে গেছে। সমস্যা সমাধানের চেয়ে বড় হয়ে দেখা গেছে তাদের নেতৃত্ব জাহির করা।

অবশেষে সকল সহকারী শিক্ষক সংগঠনের অভূতপূর্ব মিলন মেলা হলো ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সাধারণ শিক্ষকদের ধাক্কায় সহকারীদের সংগঠন ছাড়াও সকল সংগঠনের নেতাদের সমর্থনের তাবিজ পরে শোডাউন করতে দেখা গেছে। অনশনরত সাধারণ শিক্ষকেরা আশা করেছেন, এখান থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আসবে। বেতন বৈষম্য দূরীকরণ হবে।

এখানেও নেতাদের দালালি ও নেতৃত্ব জাহির করার পালা। নতুন অভিজ্ঞতাবিহীন নেতৃত্ব ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টকশোতে হোঁচট খেয়ে আন্দোলনের তেরটা বাজিয়েছে। অপরদিকে মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী দিয়ে কোনোরকম অনশন ভাঙ্গাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। মাননীয় মন্ত্রী কোনোরকম আশ্বাস না দিয়ে অনশন ভাঙ্গাতে গেলে সাধারণ শিক্ষকদের তোপের মুখে পড়েন। মন্ত্রী মহোদয় তাঁর বক্তব্যে বলেন, আপনাদের নেতারা আমাকে অনুরোধ করে অনশন ভাঙ্গাতে এনেছেন। তোষামোদকারী নেতৃবৃন্দ বলে এ তীব্র লজ্জা তাদের গায়ে মাখেনি। তখন যদি আমি নেতা হয়ে সে মঞ্চে থাকতাম সত্য না হলে আমি মন্ত্রীর বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতাম। অবশ্য অনশনরত শিক্ষকদের তীব্র চাপে মন্ত্রী মহোদয় ন্যায্যতার ভিত্তিতে দায়সারা বৈষম্য দূরীকরণের ঘোষণা দিয়ে অনশন ভাঙ্গান।

এরপরে সময়ক্ষেপণের পালা চলতে থাকে। মহাপরিচালকের দপ্তরে নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা যা ফেসবুকে দেখা গেছে। অবশেষে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন, সময়ক্ষেপণের আরেক পালা। নির্বাচন আসন্ন, শিক্ষকবান্ধব সরকার বৈষম্যের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে তা যুক্ত করে নেয়। এলো নতুন প্রতিমন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক তারা অতীত, ঘটনা, ইতিহাস, ফাইলের লেখালেখি সবকিছুই আমলে না নিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু করেন। ইহাও সময়ক্ষেপণ ও ষড়যন্ত্রের এক অপকৌশল। সাবেক মন্ত্রী, সচিব, ডিজি কী অন্যকোনো ভাবাদর্শের? কেন তাদের চূড়ান্ত কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়নি। নাকি, তাদের সবকিছু অভিনয় ছিল।

সহকারীদের একাংশ আন্দোলনের নামে রমজান মাসে ঢাকায় অবস্থান ধর্মঘট ডাকায় আসলো আরেক আশ্বাসের বাণী। সচিব মহোদয় মার্চ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যে প্রাথমিকের সহকারীদের বেতন বৈষম্য দূর করার ঘোষণা দিলেন। আমার প্রত্যাশা সচিব মহোদয় যেন মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ সময় থাকেন। যাতে প্রাথমিকের এ যেন শেষ আশ্বাস হয়। এ আশ্বাসের প্রেক্ষাপটে আমার শিক্ষক আন্দোলন স্মৃতি তুলে ধরছি। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপি সরকার ঢাকা মহানগরীর প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা পৌরসভা ও সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম সরকারের কাছে হস্তান্তর করেন। সে আন্দোলন সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩ মাস ১০ দিন তালাবদ্ধ ছিল। সে সুবাদে স্থানীয় ঢাকা পৌরসভার জনৈক ওয়ার্ড কমিশনার শিক্ষকদের ডেকে তাদের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকবেন বলে তারা অঙ্গীকার ব্যক্ত করে শিক্ষকদের ঢাকা পৌরসভার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার অনুরোধ করেন।

সে অনুষ্ঠানে কমিশনার মহোদয়কে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কি পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন ও আজীবন কমিশনার থাকবেন? তিনি উত্তরে বললেন এ কী করে সম্ভব? আমি বললাম, তাই যদি হয় আপনার অবর্তমানে শিক্ষকদের দেখভাল আপনার মতো করবে তার গ্যারান্টি কী দিতে পারবেন? অবশেষে তিনি আমার সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

আরেকটি ঘটনা খলিফা হজরত ওমর (র.) এর সময়ে। হযরত ওমর (র.) যে টাকা মাসিক ভাতা পেতেন তা দিয়ে অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করতেন। সে সময়ে সরকারি কোষাগারের রক্ষক আবু উবাইদা পবিত্র ঈদের আনন্দ উদযাপানের জন্য তার কাছে তিনি ১ মাসের অগ্রিম অর্থ প্রার্থনা করলেন। ইবনে আবু উবাইদা জবাবে বললেন, হে খলিফা আমিরুল মোমেনিন আপনি কী আগামী ১ মাস জীবিত থাকবেন বা খলিফা হিসাবে থাকবেন এর নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? তা না হলে আমি কী করে আপনাকে অগ্রিম অর্থ দিব? মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও সচিব আপনার ইতিবাচক আশাবাদী বক্তব্যে প্রাথমিক শিক্ষকেরা আশাবাদী, উপরের উদাহরণ দুটি একটু অনুধাবন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে দ্রুত সমস্যা দূরীকরণ করুন। আশা করি প্রাথমিকের বৈষম্য দূরীকরণে সমাধানের ব্যাপারে অন্যদের মতো আপনাদের হতে হবে না প্রশ্নের সম্মুখীন। 

প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের আশা এ যেন শেষ আশ্বাস হয়। নেতৃবৃন্দ আপনাদের দায় অনেক। প্রাথমিক শিক্ষকদের অতীতের সংগ্রামী ইতিহাস বজায় রাখুন। নেতৃত্ব প্রসারতা বৃদ্ধি করতে হলে শিক্ষকদের পাশে থাকুন। প্রাথমিকের সহকারীদের বেতন বৈষম্য, অভিন্ন কর্মঘণ্টা, পাঠ্যবই, মূল্যায়ন পদ্ধতিসহ সকল বৈষম্য দূর হোক এ প্রত্যাশায়। মহান সৃষ্টিকর্তা সহায় হবেন। 

লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043869018554688