কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষ জনশক্তি প্রেক্ষাপট উচ্চশিক্ষা - দৈনিকশিক্ষা

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষ জনশক্তি প্রেক্ষাপট উচ্চশিক্ষা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমা। বলা যায়, আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও ধ্যানধারণার ভিত্তিতে ১৯২১ সালে ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশ নামক এ ভূখণ্ডে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। তবে ১৪০০-২০০০ বছর আগের এ অঞ্চলের পুণ্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থানগড়), পাহাড়পুর ও ময়নামতির বৌদ্ধ মঠগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষার নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বাংলাদেশ থেকে বেশি দূরে নয় এবং সপ্তম শতাব্দীতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন শীলাভদ্র নামক একজন বাঙালি। বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী। তবে, এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। এদেশকে একটি মেধাসম্পন্ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ উন্নত জাতি গড়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর (প্রথম বিজয় দিবস) বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

 নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি উচ্চশিক্ষার প্রতি তার সর্বোচ্চ প্রাধান্য ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরেন। উচ্চশিক্ষার প্রসার ও মানসম্মত উন্নয়নই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে আসীন করার পথকে সুগম করবে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে ২০০৯ সালের ১.৬ মিলিয়ন শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে ৩.৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থীতে উন্নীত হয়েছে, যা একটি কোয়ান্টাম জাম্প। এটি স্পষ্ট যে, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এ দেশের উদীয়মান বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সমৃদ্ধি পূর্ব এশিয়া ও নর্ডিক অঞ্চলের দেশগুলোয় দৃশ্যমান।

একটা সময় ছিল যখন প্রযুক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন বহির্বিশ্বের প্রযুক্তির ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। একসময়ের স্বল্প উন্নত দেশ বাংলাদেশ, এখন সব ক্ষেত্রেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। বেড়েছে শিক্ষার হার। কিন্তু এখনো বাড়েনি কর্মসংস্থানের সংখ্যা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও )‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে (২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত) বলা হয়েছে যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে, যা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রতি বছর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

সুতরাং প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা আমাদের জন্য অবধারিত। সময় বদলে যাচ্ছে। লোকেরা নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, ঠিক তেমনি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও তাল মিলিয়ে তা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক কর্মীশক্তি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে শুধু নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির ভবিষ্যতও ছাত্রদের হাতেই রয়েছে।

এটি অবশ্যই ছাত্রদের তালিকাভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব জীবনের কাজের পরিবেশ অনুভব করার একটি সুযোগ প্রদান করবে। বাধ্যতামূলক বিশেষায়িত কোর্স, প্রয়োজনীয় ভাষা শিক্ষা, প্রজেক্ট ও ইন্টার্নশিপগুলোও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই স্নাতক হওয়ার আগে তারা বিশেষ যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছে তার ওপর দক্ষতা দেখাতে হবে। এগুলি যথেষ্ট নয় যে তারা স্নাতক। তাদের অবশ্যই উচ্চ দক্ষ স্নাতক হতে হবে। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই তাদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে জীবনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত শ্রেণিকক্ষ পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং এমন পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করবে, যা পরিবর্তিত আধুনিক ও সমসাময়িক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। একটি দেশের ভবিষ্যত্ তার উত্পাদিত কর্মীদের মানের ওপর নির্ভর করে। উন্নত মান আনয়নকারী কর্মীরা তারা, যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জ্ঞান ও দক্ষতায় সুনিপুণ এবং বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলি গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

বর্তমানে জাতীয় শিক্ষানীতিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মিল রেখে উচ্চশিক্ষার কৌশল নির্ধারণ করা হয় ।

সুপারিশমালা :

যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন সারে, লিসেস্টার, লিভারপুল ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগের যোগ্য করে গড়ে তুলতে ছাত্রদের শেখায় কীভাবে একটি চাকরি পাবে, এমনকি পোশাক, সাক্ষাত্কার ও বায়োডাটা কীভাবে তৈরি করা যায়, তাও শেখানো হয়। এরকম একটি ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।

প্রচলিত স্নাতক প্রোগ্রামগুলোর জন্য সুপারিশমালা :

প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজগুলোতে একটা মাল্টিমিডিয়া ডিসিপ্লিনারি সেন্টার থাকবে। সেই সেন্টার থেকে নন-একাডেমিক কোর্স যেমন :প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় প্রতিনিয়ত অফার করবে, যা থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো কোর্স বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করবে এবং এর সবগুলো কোর্স অবশ্যই বাধ্যতামূলক হবে। এই সেন্টার এর কাজই হবে যুগের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন কোর্স চালিয়ে যাওয়া, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চাকরির দুনিয়ায় নিজেদের প্রস্তুত করবে। ভাষার জন্য দুই ক্রেডিট এবং বিশেষায়িত কোর্সের জন্য ছয় ক্রেডিট। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে শেষ বর্ষে গিয়ে একটা প্রকল্প/ইন্টার্নশিপ করতে হবে। এসব কিছু সম্পূর্ণ করলে একজন শিক্ষার্থী ডিগ্রিপ্রাপ্ত হবে। এছাড়াও—

১। শিক্ষকদের নতুন নতুন বিষয় ও প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান।

২। মাল্টিডিসিপ্লিনারি এডুকেশন সেন্টার স্থাপন।

৩। বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে :

ক) বিশেষায়িত কোর্স (প্রোগ্রামিং, নেটওয়ার্কিং, আইওটি, এআই, এমএল, ট্রেড কোর্স)

খ) ভাষা : যেমন জাপানিজ, চাইনিজ, কোরিয়ান ইত্যাদি।

৪। ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন।

৫। বাধ্যতামূলক প্রজেক্ট অথবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট।

চিত্র : দক্ষতামূলক কোর্সগুলো নিয়ে ডিগ্রি প্রোগ্রাম

আমাদের উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা চাকরি তো পাচ্ছে, কিন্তু যে বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছে সেই বিষয়ের সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্রের কোনো প্রকার সংযোগ থাকছে না। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দেশের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হচ্ছে, ফলে কোটি কোটি অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে। দেশের জনশক্তি দেশের বাইরে কাজ পাচ্ছে না ভাষাগত অজ্ঞতার কারণে। এসব সমস্যার একটি সমাধান, তা হলো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, যারা শিক্ষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কর্মেও দক্ষ হবে। এরই সঙ্গে বাড়াতে হবে যথেষ্ট কর্মসংস্থান, যাতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা না বাড়ে। সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে এই সমস্যার সমাধানে। প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনার।

লেখক : প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038459300994873