পদ সৃষ্টি ছাড়াই একাদশ শ্রেণী বা কলেজ চালু করায় সঙ্কটের মুখে পড়েছে বহু সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। একাদশ শ্রেণী চালুর ১২ বছর পরও আজ পর্যন্ত এসব বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণীর জন্য শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সঙ্কট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় পদ সৃষ্টির প্রস্তাব দিলেও ফল শূন্য। অথচ ইতোমধ্যেই সঙ্কটে পড়ে তিনটি বিদ্যালয়ে একাদশের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি প্রতিষ্ঠানে জোড়াতালি দিয়ে স্কুল শিক্ষক ও খন্ডকালীন বেসরকারী কলেজ শিক্ষক দিয়েই চলছে সরকারী কলেজ শিক্ষা! এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির কারণে মাউশির কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাহস পাচ্ছেন না। তবে কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আমরা পদ সৃষ্টির জন্য যেসব প্রস্তাব করেছিলাম তা মন্ত্রণালয়ে সেভাবেই পড়ে আছে। পদ সৃষ্টি হয়নি। উপায় না দেখে কয়েকজন শিক্ষককে সংযুক্ত হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিল এসব প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তারাও সেখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছেন। এখন সমস্যা আরও বেড়েছে। স্কুল শাখায় শিক্ষকদের দিয়ে কলেজের কাজ চালানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবার জোরালেও তাগিদ দেয়ার কথা বলেছেন মাউশির বতৃমান মহাপরিচালক অধ্যাপক গোলাম ফারুক। যদিও তার আগেও বেশ কয়েকজন মহাপরিচালক ও পরিচালক এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েও সফল হতে পারেননি। শনিবার (১৭ জানুয়ারি) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিভাষ বাড়ৈ।
জানা গেছে, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বড় ও মানসম্পন্ন সরকারী বিদ্যালয়েই চালু করা হয়েছিল একাদশ শ্রেণী। ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ ও ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে দেশের সবচেয়ে বড় ১১টি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণীতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। প্রথমে স্কুলগুলোতে দু’তিন জন করে সরকারী কলেজের প্রভাষক পদায়ন বা পদায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তীতে আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। স্কুলগুলোতে দু’একজন কলেজ শিক্ষক পদায়ন হলেও তারা স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে চাকরি করতে স্বস্তিবোধ করছে না।
আবার স্কুল শিক্ষকরাও কলেজ শিক্ষকদের মেনে নিতে পারছেন না। কলেজ শাখার জন্য পৃথক শিক্ষক না থাকায় প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের। প্রাইভেট টিউশনির লোভে পার্শ্ববর্তী বেসরকারী কলেজের শিক্ষকরা সম্মানী ভাতা ছাড়াই সরকারী স্কুলের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। মতিঝিল সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলছিলেন, আমাদের স্কুলে একাদশ শ্রেণীতে বহু ছাত্র আছে। অথচ তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন শিক্ষক নেই। স্কুল শাখার শিক্ষক দিয়েই ছাত্রদের পাঠদান করা হচ্ছে। বারবার দাবি জানালেও কলেজ শাখার জন্য পদ সৃষ্টি হচ্ছে না।
একই কথা জানালেন গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষকরাও। তারা বলছেন, এসব বিষয়ে কথা বললে এখন মন্ত্রণালয় ও মাউশির কর্মকর্তারা নাখোশ হন। মাউশির কর্মকর্তারা বলেন তারা বহু প্রস্তাব দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ে, কাজ হচ্ছেনা। আমাদের আর কিছু করার নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সরকারী কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সঙ্কুলান না হওয়া ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথমে রাজধানীর দু’টি স্কুলে একাদশ শ্রেণীতে পাঠদান চালু করা হয়। প্রতিষ্ঠান দু’টি হলো গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এবং শেরেবাংলা নগর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। পরবর্তীতে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে সাতটি প্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়। স্কুলগুলো হলো- রাজধানীর শেরেবাংলা নগর সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়, খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল, খুলনা জিলা স্কুল এবং বরিশাল জিলা স্কুল।
পরে সুনামগঞ্জের সরকারী এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সিলেটের সরকারী অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও একাদশ শ্রেণীতে পাঠদান চালু করা হয়। শিক্ষকের পদ সৃষ্টি না হওয়ায় দু’তিন বছর পর খুলনা জিলা স্কুল, বরিশাল জিলা স্কুল ও সুনামগঞ্জ এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
একাদশ শ্রেণীর একাডেমিক কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব পালনের কথা মাউশি’র আঞ্চলিক উপ-পরিচালকদের (ডিডি)। তবে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, ১১ স্কুলের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি হচ্ছে না বললেই চলে। কারণ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি করতেই উপ-পরিচালকদের হিমশিম খেতে হয়। মাউশি’র ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক (ডিডি) সাখায়েত হোসেন বলছিলেন, এটা আসলেই একটা বড় সঙ্কট আমাদের শিক্ষার জন্য। মাউশি প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু পদ সৃষ্টির কোন উদ্যোগ হয়নি। স্কুল শাখার শিক্ষক দিয়ে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে কোনমতে।
এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষকের পদ থাকলে কোন প্রতিষ্ঠানেই একাদশের কার্যক্রম চালু করেও বন্ধ হতো না। শিক্ষকরা সব সময়েই এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু মাউশি চেষ্টা করছে সব সময়েই।
মাউশি জানিয়েছে, স্কুলগুলোতে একাদশ শ্রেণীতে পাঠদানের জন্য কোন কলেজ শিক্ষক নেই। অধ্যক্ষের (অধ্যাপক) পদও সৃষ্টি করা হয়নি। প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকের পদ সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়েছে বহুবার, কিন্তু কোন কাজ হয়নি। সরকারী স্কুলে এমনিতেই শিক্ষক-কর্মচারী স্বল্পতা আছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব শিক্ষকের অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী আছে, তাদের দিয়েই বর্তমানে নামকাওয়াস্তে একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে স্কুলে। অথচ এসব স্কুলে এমনিতেই আছে শিক্ষক সঙ্কট। এর মধ্যেই জোড়াতালি দিয়ে কলেজ শাখার একাডেমিক কার্যক্রমও চলছে।
জানা গেছে, ১১টি স্কুলের কলেজ শাখার জন্য স্কুল প্রতি ২০ জন শিক্ষক এবং ১০ জন কর্মচারী নিয়োগের জন্য প্রথমে ২০০৯ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ের কিছু আমলার চরম গাফিলতির জন্য এই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখা তো দূরের কথা, এ নিয়ে কোন আলোচনাই হয়না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকরা। ঢাকার অপর একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, শিক্ষক স্বল্পতা নিয়ে খুব কষ্টে আছি। স্কুল শিক্ষক দিয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পদ সৃষ্টি না করেই হঠাৎ এই স্কুলে একাদশ শ্রেণী চালু করা হয়। প্রথমে তিনজন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে আর পদ সৃষ্টি করা হয়নি।
এদিকে মাউশি সূত্রে জানা গেছে, সরকারী স্কুলে এমনিতেই শিক্ষক সঙ্কট ভয়াবহ। বর্তমানে দেশের ৩৩৩টি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের পদ আছে দশ হাজার ছয়টি। এর মধ্যে এক হাজার ৬৯১টি পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীর পদও শূন্য রয়েছে প্রায় দুই হাজার। প্রধান শিক্ষক নেই প্রায় ১০০ বিদ্যালয়ে। এই তীব্র শিক্ষক স্বল্পতার মধ্যেই সহকারী শিক্ষক দিয়ে স্কুলে কলেজ শাখার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে নামকাওয়াস্তে।
তাহলে সমাধান কি? মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক গোলাম ফারুক রবিবার সন্ধ্যায় বলেন, এসব সরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্কটের এ বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই আমরা আলোচনা করেছি। দ্রুত সঙ্কটের সমাধানের জন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দেব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমরা জোরালো তাগিদ দেব, যাতে পদ সৃষ্টি হয়।