কলেজ শিক্ষকদের আত্তীকরণ - দৈনিকশিক্ষা

কলেজ শিক্ষকদের আত্তীকরণ

সনোজ কুণ্ডু |

 শিক্ষক হলেন মূল্যবোধ বিনির্মাণের রূপকার। সমাজে জ্ঞান বিস্তার ও নৈতিক চেতনা জাগ্রত করার মহান কারিগর। সে ‘চিরউন্নত শিক্ষাগুরু’রা সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে দিন কাটাচ্ছেন চরম উৎকণ্ঠায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৪২টি কলেজ জাতীয়করণের নামে জিও জারি হয়েছে। অপেক্ষায় রয়েছে আরো ২৮৩টি  কলেজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিতর্কিত আত্তীকরণ বিধিমালা ২০০০ এর খড়গ চাপিয়ে তথাকথিত কাম্যযোগ্যতার প্রশ্নে বহু অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ প্রভাষকদের পাসকোর্স কিংবা অনার্সে তৃতীয় বিভাগ এবং প্রদর্শকদের বিএসসিতে তৃতীয় এবং সহকারী গ্রন্থাগারিকদের ডিপ্লোমায় দ্বিতীয় বিভাগ না থাকায় প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষকদের আত্তীকরণ বঞ্চিত করা হয়েছে। 

সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে শিক্ষকরা আজ জ্ঞানের বিশুদ্ধ উদ্যান ছেড়ে নেমেছে রাজপথে। কখনো প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে, আবার কখনো আদালত পাড়ায়। যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তারা মামলার পেছনে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করছে। সামাজিক, পারিবারিক এমন কি নিজ সন্তানের কাছেও মাথা নিচু করে বাঁচতে হচ্ছে। তাদের নীরব আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠান চত্বর। এর প্রভাব পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীর ওপর। গোটা জাতির জন্য এটা আতঙ্কজনক পূর্বাভাস।
 
বিধির ২ (গ) উপধারাটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার সূক্ষ্ম দৃষ্টান্ত। যেখানে চাকরিকাল ৫০ শতাংশ ধরে আত্তীকৃত হবার বিধান রয়েছে। বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সহকারী অধ্যাপকদের পিএসসির নিয়োগকৃত সর্বশেষ ব্যাচের জুনিয়র ক্যাডার কর্মকর্তার নীচে অনুশাসন জারি শিক্ষকদের মর্যাদা ও মানবিক অধিকার বিনষ্ট করা ছাড়া কিছুই নয়।
 
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও পড়েছে যেন গোলক ধাঁধাঁয়। নিজের ঘরেই যেন তারা অতিথি। গলায় বেঁধা কাঁটা না পারছে উগড়ে ফেলতে, না পারছে গিলতে। বঞ্চিত শিক্ষক সমিতির শীর্ষ নেতারা প্রতি সপ্তাহেই শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রতিটি টেবিলে গিয়ে তাদের দাবি উপস্থাপন করা সত্ত্বেও কর্মকর্তারা সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না। সুষ্ঠু নীতিমালা চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারির আশ্বাস দিয়ে শিক্ষকদের হাসিমুখে বিদায় করছেন। দিনের পর দিন তাদের আশ্বাস শুনতে শুনতেই কেউ কেউ চাকরিকাল শেষ করেছেন, কারো শেষ হবার পথে, আবার কেউ কেউ মারাও গেছেন। আত্তীকরণ বিধিমালা ১৯৮১ ও ১৯৯৮ বিধিমতে বঞ্চিত শিক্ষকরা দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে যোগ্যতার প্রমাণ সাপেক্ষে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন। অথচ আত্তীকরণ বিধিমালা- ১৯৯৮ এর ঠিক দুই বছর পরই অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুমোদন ছাড়াই তৎকালীন শিক্ষাপ্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ২০০০ নামকরণে এই বিতর্কিত বিধিটি তৈরি করেন।

অভিশপ্ত এই ২০০০ বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, পাসকোর্স ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের কিংবা অনার্সে তৃতীয় শ্রেণি থাকার কারণে মানোন্নয়ন পরীক্ষার মাধ্যমে সনদ অর্জন করে তাদের কাম্য যোগ্যতার প্রমাণ দিলে আত্তীকৃত হবেন। এটা শিক্ষককুলের জন্য লজ্জার। বহু অভিজ্ঞ শিক্ষক ২০-২৫ বছর ধরে চাকরি করছেন। অনেকের চাকরিকাল প্রায় শেষের পথে; শেষ জীবনে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ দেয়া শিক্ষককূলের জন্য ভীষণ অপমানের। বিতর্কিত আইনের আরও নির্মম নিদর্শন হলো, জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আসবাবপত্রসহ সকল জমি, ভবন, বৃক্ষরাজি সবই সরকারি পেপার্স তালিকায় থাকবে। অথচ ক্যাডার কর্মকর্তাদের বানানো শব্দ ‘কাম্যযোগ্যতা’ না থাকায় আত্তীকরণবঞ্চিত সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী বহু অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ প্রভাষকদের বেতন আর একজন পিয়ন কিংবা নৈশ্যপ্রহরীর বেতনের মধ্যে খুব বেশি ব্যবধান হবে না। কারণ তাদের কাম্যযোগ্যতা স্বীকৃতি দিয়েই সরকারি যাবতীয় সুবিধা ভোগ করবেন। 

অথচ আজকের বঞ্চিত শিক্ষকদের অনেকেই নিজস্ব জমি দান করে, চাঁদা দিয়ে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাঁশ-কাঠ-টিন সংগ্রহ করে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু সমাজে শিক্ষার আলো জ্বালাতে বছরের পর বছর বিনা বেতনে চাকরি করেছেন। সেদিন কোথায় ছিল ২০০০ বিধি, যেদিন অনেক শিক্ষক জীবনের মায়া ত্যাগ করে নেমেছিলেন স্বৈরাচারী সরকার বিরোধী আন্দোলনে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনা বুকে ধারণ করে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ছিলেন তারা রাজপথে।পড়ালেখার সুষ্ঠ পরিবেশ ছিল না। তাছাড়া তখনকার সময়ে উপজেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ না থাকায় বাধ্য হয়েই পাস কোর্সে ভর্তি হতে হতো। কেউ কেউ অনার্স কোর্সে পড়েও প্রত্যাশিত রেজাল্ট পাননি। এটিই ছিল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান প্রচলিত ধারা। তার ওপর ভিত্তি করেই দেশের বিসিএস থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ এমন কোনো প্রশাসনিক দপ্তর নেই, যেখানে তারা চাকরি করেননি। এমন কি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও অনার্সে তৃতীয় শ্রেণি কিংবা পাসকোর্সধারী শিক্ষকের বহু নজির রয়েছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে একযোগে দেশের ১৮টি মহিলা কলেজ জাতীয়করণ করা হলো প্রচলিত আইনকে শিথিল করে। শুধু মানবতার প্রশ্নে সরকার কাম্য যোগ্যতাহীন বহু শিক্ষককে আত্তীকরণ করে মহানুভবতারই পরিচয় দিয়েছেন। আইন তো মানুষের জন্য, সমাজের কল্যাণের জন্য; বিতর্কিত আইন অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করে কখনো মানবতাকে রক্ষা করা যায় না। দয়া ভিক্ষায় নয়, কারো করুণায় নয়; ‘চিরউন্নত শিক্ষাগুরু’র মর্যাদা নিয়ে তাঁরা বাঁচতে চান।

পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষকদের মান-মর্যাদা, অস্তিত্ব যার হাতে নিরাপদ, তিনি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে দেশ ও জাতি বার বার মহাসংকট থেকে মুক্তি পেয়েছে। জাতির সামনে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন ‘মুক্তির অগ্রদূত’ হয়ে, কখনো ‘মানবতার জননী’ রূপে; আবার কখনো মেধাবী ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করায় ‘মাদার অব এডুকেশন’ উপাধি পেয়ে। গোটা জাতিকে গর্বিত করেছেন তিনি। তিনিই আমাদের শেষ আশ্রয়, শেষ ভরসা। তাঁর কাছে আমাদের নিবেদন, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সব জাতীয়করণকৃত কলেজের বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত আত্তীকরণ বঞ্চিত শিক্ষককূলের সম্মান ও অস্তিত্ব রক্ষায় তিনি যেন একটি যুগোপযোগী, বৈষম্যহীন, শিক্ষকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়নে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেন।   

লেখক : প্রভাষক, সরকারি মুকসুদপুর কলেজ, গোপালগঞ্জ।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004194974899292