সর্বশেষ ঘোষিত সরকারি কলেজগুলোর প্রতি সবার আরো বেশি মনোনিবেশ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষকের স্বল্পতা, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে অধ্যক্ষশূন্য থাকাটা এসব প্রতিষ্ঠানে দুরারোগ্য ব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। অধ্যক্ষের পদ শূন্য, গভর্নিং বডি বাতিল—এমন পরিস্থিতিতে কলেজে কলেজে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’রা প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে একদিকে হচ্ছেন গলদঘর্ম, অন্যদিকে তাঁদের কর্মকাণ্ডে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই কোনো কার্যকর গতি। তাঁদের মধ্যে অযোগ্য, অদক্ষ, সংকীর্ণমনা ও স্বার্থান্বেষীদের স্বেচ্ছাচারিতায় আইন ও বিধি-বিধান লঙ্ঘিত হওয়া, এমনকি সরকারের ভাবমূর্তিও দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাই শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মচারী, প্রতিষ্ঠান তথা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যেসব কলেজে অধ্যক্ষের পদ শূন্য রয়েছে সেগুলোতে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া একান্ত জরুরি। সোমবার (১০ জুন) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন বিমল সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহ ও নির্দেশে সরকার যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি কলেজ ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই, সেসব উপজেলায় একটি করে কলেজ ও একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দফায় দফায় নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন (ইন্সপেকশন) কাজ সম্পন্ন হয়েছে অনেক আগেই। দানপত্র (ডিড অব গিফট) সম্পাদনের পর প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে জারি হয় সরকারি আদেশ (জিও)। ২০১৬ সালে ঘোষণায় একের পর এক বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সরকারীকরণের শেষ ধাপ বলে বিবেচিত শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়নের কাজও নাকি সম্পন্ন হওয়ার পথে। যেকোনো স্তরেরই হোক মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা স্তরে একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করা আমাদের দেশে এই প্রথম। এমন একটি মহতী উদ্যোগ ও কার্যক্রমে শুধু বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী নয়, বলা যায় সর্বস্তরের মানুষের মনেই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
২.
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথা এখানে নয়, সরকারীকরণের উল্লিখিত প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে ২৯৯টি কলেজ। লক্ষ করার বিষয় যে এই ২৯৯টির মধ্যে ৯০টি কলেজেই অধ্যক্ষের পদ খালি। আনুমানিক ৭০টি কলেজ রয়েছে একই সঙ্গে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষবিহীন। দুই বছর, চার বছর, এমনকি টানা পাঁচ-সাত বছর ধরে কলেজগুলো চলছে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ দিয়ে। ‘ভারপ্রাপ্ত’ একটি সাময়িক ব্যবস্থা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কখনো কখনো তা হতেই পারে। তাই বলে বছরের পর বছর, চার বা পাঁচ বছর কিংবা আরো বেশি সময় ধরে? কলেজের মতো একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; যেগুলোতে দুই হাজার, তিন-চার হাজার বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী, ৮০ বা ১০০ কিংবা এর চেয়েও বেশি সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী! একাদশ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কি আর শেষ আছে? আরো কত কর্মকাণ্ড। অথচ অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষহীন একেকটি প্রতিষ্ঠান!
৩.
সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়াবহ হচ্ছে যখন কোনো ভারপ্রাপ্ত বিদায়কালে তাঁর স্থলে অন্য একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ‘নিযুক্ত’ করে যান। আইন, বিধি-বিধান, রীতিনীতি কোনো কিছুকেই যেন কিছু মনে করেন না তাঁরা। এ নিয়ে কলেজে কলেজে বিপত্তি ও শিক্ষক-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের ভোগান্তি-বিড়ম্বনার কোনো শেষ নেই। না জানাটা সব সময় খারাপ কিছু নয়। আধা জানা থাকলেও মোটামুটি কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু জেনেশুনে যারা ‘স্বার্থ রক্ষা’ ও ‘স্বার্থ উদ্ধারে’ বাধাহীনভাবে কাজ চালিয়ে যান, তাঁদের বেলায়? একটি নয়, দুটিও নয়, এমন অনেক কলেজ রয়েছে, যেগুলোতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে বছরের পর বছর দায়িত্ব পালন করে বিদায়ের বেলা (৬০ বছর) হলে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তৃতীয়, চতুর্থ, এমনকি পঞ্চম জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ বানিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন অনেককে জানি, যাঁরা এমন কাজটি অবলীলায় করে চলে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং তিন মাস, ছয় মাস, এমনকি আরো বেশি সময় পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিংবা মাননীয় আদালতের আদেশে ‘মনগড়া নিযুক্তি’ বাতিল করে আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে সরকারেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন-তেমন, সদ্য সরকারি হওয়া, বিশেষ করে কলেজগুলোতে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়াটা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে সরকারীকরণের উদ্দেশ্যই দারুণভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দুর্ভাগ্য ও বিড়ম্বনার ব্যাপার হলো ভারপ্রাপ্তরা দায়িত্বে থাকাকালে যেমন, অবসরগ্রহণের পরও যেন সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারী তথা সংশ্লিষ্টদের কাছে ‘ভার’ হয়েই থেকে যাচ্ছেন। বৃহত্তর স্বার্থেই এর নিরসন হওয়া দরকার।
লেখক : কলেজ শিক্ষক