দু'হাজার আট সালে মুম্বাইয়ে ২৬/১১-র জঙ্গী হামলাকে লস্কর-ই-তৈয়বা একটি 'হিন্দু সন্ত্রাসে'র চেহারা দিতে চেয়েছিল বলে দাবি করেছেন শহরের একজন সাবেক পুলিশ কমিশনার।
রাকেশ মারিয়া তার সদ্যপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে বলেছেন, আজমল কাসাব নামে যে জঙ্গী সে দিন জীবিত ধরা পড়েছিল, তার কাছে হিন্দু নামের জাল পরিচয়পত্র পাওয়া গিয়েছিল - এমন কী নিজেকে হিন্দু প্রমাণ করতে সে হাতে গেরুয়া সুতোও বেঁধেছিল। বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শুভজ্যোতি ঘোষ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, তিনি এই তথ্য প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে শাসক দল বিজেপি বলছে, হিন্দু সন্ত্রাসের নামে কংগ্রেস যে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়েছে এটা তারই প্রমাণ।
অন্যদিকে কংগ্রেসের বক্তব্য, জঙ্গীরা সব সময়ই জাল পরিচয়পত্র নিয়ে ঘোরে - তা থেকে কোনও উপসংহারে পৌঁছনো যায় না।
রাকেশ মারিয়া মুম্বাইয়ের একজন ডাকাবুকো 'সুপারকপ' হিসেবেই পরিচিত - শহরের পুলিশ-প্রধানের দায়িত্ব সামলানো ছাড়াও তিনি বহু হাই-প্রোফাইল মামলার তদন্তেরও দায়িত্বে ছিলেন।
'লেট মি সে ইট নাও' নামে তার যে স্মৃতিকথা সদ্যই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি এমন কিছু দাবি করেছেন যা নিয়ে ভারতে শোরগোল পড়ে গেছে।
তিনি জানিয়েছেন, ২৬/১১-র হামলায় সব জঙ্গীকেই হিন্দু সাজিয়ে সেটিকে একটি 'হিন্দু সন্ত্রাসে'র চেহারা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
জীবিত ধরা পড়া আজমল কাসাবের কাছে ব্যাঙ্গালোর নিবাসী ছাত্র 'সমীর দীনেশ চৌধুরী'র নামে যে জাল পরিচয়পত্র পাওয়া গিয়েছিল - ও তার হাতে যে লাল ও গেরুয়া ধাগা বাঁধা ছিল, তাতেই সেটা প্রমাণিত বলে তিনি দাবি করেছেন।
বিজেপি ও আরএসএসের শীর্ষস্থানীয় নেতা রাম মাধব বলছেন, "পাকিস্তানের আইএসআই যে একে হিন্দু সন্ত্রাস হিসেবে সাজাতে চেয়েছিল, রাকেশ মারিয়ার বই প্রমাণ করে দিয়েছে যে সে চেষ্টা সফল হয়নি।"
"কিন্তু দু:খের ব্যাপার হল, কিছু কংগ্রেসের নেতাও তখন এই ষড়যন্ত্রে সামিল হতে চেয়েছিলেন।"
"মুম্বাইয়ের হামলা আসলে হিন্দুদের ও আরএসএসের কাজ বলে অনেক বুদ্ধিজীবীই সেদিন দাবি করেছিলেন, আর কংগ্রেস তাদেরকে সমর্থনও করেছিল।"
বিজেপির ক্যাবিনেট মন্ত্রী পীযূষ গোয়েলও দাবি করেছেন, তখনকার কংগ্রেস সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের নেতৃত্বেই এই 'হিন্দু সন্ত্রাসে'র কনসেপ্ট পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছিল।
রাকেশ মারিয়ার বই নিয়ে মি. চিদাম্বরম নিজে এখনও কোনও মন্তব্য করেননি, তবে পার্লামেন্টে কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী বলছেন - মক্কা মসজিদে বা সমঝোতা এক্সপ্রেসে হামলার ঘটনায় যেভাবে হিন্দু জঙ্গীদের নাম জড়িয়েছিল, তা থেকেই কিন্তু এই শব্দবন্ধটির জন্ম।
অধীর চৌধুরীর কথায়, "হিন্দু সন্ত্রাসবাদী কথাটার যেভাবে উৎপত্তি - তার ব্যাকগ্রাউন্ড আলাদা।"
"যুক্তির তালগোল পাকিয়ে আসল কথাটাকে ঘুরিয়ে দিলেই তো হল না!"
"জঙ্গীরা তো আর জঙ্গী পরিচয়ে কোথাও ঢোকে না, তারা চিরকালই ছদ্মবেশ নিয়ে চলাফেরা করে।"
"মুম্বাইতেও হয়তো তাই হয়েছিল - তারা ক্যামোফ্লাজ করে নিজেদের পরিচয় লুকোনোর চেষ্টা করেছিল, কারণ সেটাই ওদের কাজ", বলছেন অধীর চৌধুরী।
তথাকথিত 'হিন্দু সন্ত্রাস' নিয়ে নতুন করে এই রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে মুখ খুলেছেন সমঝোতা এক্সপ্রেসে বোমা বিস্ফোরণের মামলায় দন্ডিত আসামি প্রজ্ঞা ঠাকুরও।
এই হিন্দু সন্ন্যাসিনী বর্তমানে জামিনে আছেন এবং বিজেপির টিকিটে ভোপাল থেকে জিতে পার্লামেন্টেও গেছেন।
বিজেপির এই বিতর্কিত এমপি-র বক্তব্য, হিন্দু সন্ত্রাস বলে আসলে যে কিছু নেই - রাকেশ মারিয়ার বই সেটাই প্রমাণ করেছে।
তিনি বলছেন, "আমার কথা বিশ্বাস না করুন - মারিয়াজির কথা তো এখন আপনারা মানবেন।"
"আমি চিরকালই বলে এসেছি, হিন্দু সন্ত্রাস জিনিসটাই কংগ্রেসের বানানো একটা গল্পকথা, এখন সেটাই আরও একবার প্রমাণ হল।"
"একটা জিনিস কেন কংগ্রেস বোঝে না যে এসব কথাবার্তায় আমাদের প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রেরই মনোবল বাড়ে!", বলছেন তিনি।
স্পষ্টতই, বিজেপি তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই রাকেশ মারিয়ার বইকে ব্যবহার করে প্রমাণ করতে চাইছে - হিন্দুরা কখনও জঙ্গী হতে পারে না।
তবে সেখানে যে যুক্তির যথেষ্ট ফাঁক আছে, সেটাও কিন্তু পরিষ্কার।