কিশোর অপরাধ দমনে সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকের ভূমিকা - দৈনিকশিক্ষা

কিশোর অপরাধ দমনে সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকের ভূমিকা

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশেরও বেশী হচ্ছে কিশোর-কিশোরী । এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রুপান্তরিত করার নানা উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করছে। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে যে, একটি দেশে প্রকৃতিগতভাবে একবারই কিশোরবয়সী জনগোষ্ঠীর আধিক্য দেখা দেয় যাকে বলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট পিরিয়ড । এসময়ে ঐ জনগোষ্ঠীকে যদি সঠিকভাবে কোনো দেশ গড়ে তুলতে না পারে তবে ভবিষ্যতে ঐ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দুঃেখর বিষয় যে, সমাজ, শাসন-ব্যবস্থা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে বর্তমানে আমাদের দেশের যুবসমাজের একটা বিরাট অংশ হয়ে পড়ছে বিপথগামী ও কিশোর অপরাধী। কিশোর-কিশোরীরা হিরোইজম চিন্তা-ভাবনা থেকেই সংগঠিত হয়ে গ্যাং কালচার গড়ে তুলছে।  স্কুল-কলেজ এবং নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার বা দ্বন্দ্ব মেটাতে প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তা নিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুকরণে বিভিন্নস্থানে নিজেদেরকে বিচিত্র সব নামে যেমন- ফাইভ স্টার, সেভেন স্টার, আজরাইল, বন্ড, টারজান, ইবলিশ, ০০৭, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, তুফান ইত্যাদি পরিচয় দিয়ে গড়ে তুলছে গ্যাং বাহিনী। তাছাড়া ব্যক্তি নামে যেমন- লাড়া দে, নাইন স্টার, ফিফটিন, কন্টাক রোজ, ভাইপার এরকম নামে ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্যাং গ্রুপ গড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে সমগ্র জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে।

 কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা পাড়া, মহল্লা, অলিগলি ও ফুটপাতে জমিয়ে আড্ডা দেয় । তাদের পরনে থাকে টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট, চোখে সানগ্লাস, চুলে নিত্যনতুন স্টাইল; পকেট থেকে সিগারেট বের করে দামি লাইটার দিয়ে ধরিয়ে হিরোদের মতো চুরুটে টান দেয়; উচ্চস্বরে হিন্দি কিংবা ইংরেজি গান গায়; মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো বয়স বিবেচনা থাকে না।  ইভটিজিং, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, মাদক সেবন ও বেচা-কেনা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি, খুনাখুনিসহ হেন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করছে না। এসব উঠতি বয়সি শিশুরা দিনে দিনে আশঙ্কাজনক হারে দেশের বিভিন্নস্থানে অপরাধে জড়াচ্ছে। সম্প্রতি এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমুতে একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে তারা নানা স্ট্যাটাস দেয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, মহল্লায় আধিপত্য বিস্তার, ঝুঁকিপূর্ণ মোটর বাইক রাইডিং, রেসিং, ডিসকো ড্যান্স, ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ঘটছে এদের হাতে। অপরাধের নৃশংসতার মাত্রা তাদের মূল্যবোধ ও মানবিকতাবোধকে নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।   

প্রশ্ন হচ্ছে, যে বয়সে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা, সে বয়সে ছেলেমেয়েদের এমন অপরাধে জড়ানোর কারণ কী?  বিশেষজ্ঞদের মতে, শিথিল পারিবারিক বন্ধন, সন্তানকে সময় না দেয়া, সামাজিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনসহ উন্নত প্রযুক্তি উপকরণের নাগাল পাওয়া, সঙ্গদোষ, কিশোরদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা দেয়া, যৌক্তিকতা বিচার না করেই সব আবদার পূরণ করা এবং সন্তান কী করছে সে বিষয় পর্যবেক্ষণ না করা ইত্যাদি কারণে কিশোরদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না ঠিক কিন্তÍু পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে তারা ক্রমশঃ অপরাধী হয়ে উঠছে। সাধারণত তিন বছর বয়স হবার পূর্বেই শিশুদের মস্তিস্কের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটে। এই সময়ে তাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনাবোধ, কথা বলা ও শেখা, বিচার-বিবেচনা করার সামর্থ্য গড়ে উঠে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ন্যায় তাদের মূল্যবোধ ও সামাজিক আচরণের ভিত্তি রচিত হয়। শিশুদের জীবনের এই মূল্যবান সময়টা নানা কারণে অবহেলায় কাটে বিধায় এর নেতিবাচক  প্রভাব তাদেরকে অপরাধী করে তোলে। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা, পর্নোগ্রাফির প্রসার, বিশৃঙ্খল জীবনযাপন, পারষ্পরিক বিরোধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, খুন ও মারামারি বিষয়ক ভিডিও গেমস এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অভিভাবকদের উদাসীনতা, ইত্যাদি কারণে কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। 

কিশোররা নিজেকে অন্যজনের থেকে বড় প্রমাণ করতে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে গিয়েই কিশোর গ্যাং কালচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ঝোঁকের বশে, কেউ কেউ পারিবারিক-সামাজিক হতাশা থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে নানা ধরনের সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আগে গ্রামের মুরুব্বিকে সবাই ভয় পেত এখন উল্টো মুরুব্বিরাই তাদের ভয় পায়। একটা সময়ে কোনো কিশোর বা কিশোরীর আচরণে ও কথাবার্তায় অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে পাড়ার মুরুব্বিরা তাদের শাসন করতেন এবং তাদের অভিভাবকদেরকেও এ বিষয়ে সতর্ক করতেন । বর্তমান সময়ে এ ধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে খুব একটা দেখা যায় না। কারণ তাদের উপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ পর্যাপ্ত নয় । বেপরোয়া গ্যাং সদস্যদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীতে পরিণত হয় তার উদাহরণ বরগুনা শহরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যা। হত্যাকারী নয়ন বন্ডসহ অন্যরাও ০০৭ নামে একটি গ্যাংয়ের সদস্য। এমনকি যাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেই রিফাত শরীফও এক সময়কার হত্যাকারীদের সঙ্গী। যারা সবাই কিশোর বয়স থেকে গ্যাং কালচারে জড়িত থেকে নানা অপরাধ সংঘটন করে আসছিল। এমনকি এক পর্যায়ে নিজেরা মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী হয়ে পড়ে, তারা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। এছাড়া তাদের মধ্যে বান্ধবী-প্রেমিকা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিরোধও তৈরি হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে জেলা শহরগুলোর পাশাপাশি বড় উপজেলাতে ছড়িয়ে পড়েছে এ ধরনের বাজে সংস্কৃতি। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাং কালচার সামাজিক ও জাতীয় উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রধান শহরগুলোতে তরুণরা বিভিন্ন গ্যাংয়ের মাধ্যমে অপরাধ করছে। এক সমীক্ষায় মারুফ নামে এক কিশোর গ্যাং জানায় বন্ধুদের মাধ্যমে এই কাজে জড়িয়েছে, পরিবার শুরুতে বকাঝকা করলেও এখন  আর কিছু বলে না। আরো উল্টো পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের ঝামেলা হলে তাকে সমাধানের জন্য বলে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কিশোর সন্ত্রাস নতুন একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

কিশোর অপরাধের কারণ খুঁজতে যেয়ে দেখা গেছে ঘরের মধ্যে বাবা-মা যদি সবসময় নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত থাকে এবং একে অপরের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে ব্যর্থ হয় তার প্রভাব শিশু-কিশোরদের উপর পড়ে । অনেক সময় সন্তানদের সামনে বাবা-মায়ের অনৈতিক জীবন যাপনের কারণে পরিবারে যে ঘৃণ্য পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাতে সন্তানরা ক্রমশঃ আদর্শহীন এবং বেপরোয়া হয়ে উঠে। সম্প্রতি বাবা-মা উভয়েই চাকরিজীবী হওয়ায় সন্তানরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় এবং আস্তে আস্তে অপরাধ জগতে ঢুকে পড়ে। সন্তানদের  উপর পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের অভাব দেখা যায়। সন্তানরা কী প্রত্যাশা করে তা অনেক অভিভাবকই স্পষ্ট জানেন না।  অনেকক্ষেত্রে সংসার জীবনকে জামেলা মনে করে দৈনন্দিন দায় থেকে নিজেরা দূরে সরে থাকে ফলে একজন উঠতি বয়সী কিশোর পরিবার থেকে যে নৈতিক শিক্ষা পাওয়ার কথা তা পায় না। শিশু-কিশোররা তাদের সমবয়সী ও সহপাঠী ধনী পরিবারের সন্তানদের মতোই সবকিছু পেতে চায়। এই অসম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে অনেক সময় দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোররা অপরাধী হয়ে পড়ে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের অভাব পূরণের লক্ষ্যে শিশু-কিশোররা ছোটবেলা থেকেই কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে এবং প্রয়োজনীয় শ্রমের অভাবে প্রথমে তারা ছোটখাট চুরি, ছিনতাইয়ের পথ বেছে নেয় এবং পরে বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে দারিদ্রই যে সকল অপরাধের উৎস তা কিন্তÍু সঠিক নয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, অপরাধে জড়িত কিশোরদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও আছে। 

ইদানিংকালে দেখা যাচেছ সমাজের সম্ভ্রান্ত উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকা-ে বেশী জড়িয়ে পড়ছে।  বিত্তশালী অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের নামি-দামি স্কুল-কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব সম্পন্ন হয়েছে মনে করে গর্ববোধ করেন। অথচ স্কুল-কলেজে বা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে যাবার কথা বলে কোথায় যায়, কি করে, বাবা-মা সে খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। এসব অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের সংশোধন করার চেয়েও অর্থের বিনিময়ে সন্তানদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করেন। তাছাড়া পাঠ্যবই বা সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের খোড়া যুক্তির কারণে শিশু-কিশোররা পাঠ্য বই এবং সমাজ থেকে নৈতিকতা লাভ করতে পারছে না। মূল্যবোধহীন থাকার কারণে বিদেশী টিভি চ্যানেল বা অপসংস্কৃতির প্রভাব দ্রুত শ্শিুদের মধ্যে প্রবেশ করছে। অথচ শিশু শে্িরণ থেকে যদি তাদের ধর্মীয় নৈতিকতার ভিত্তি তৈরী করা যেত, তবে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সেটা তারা নিজ থেকে যাচাই করে নিতে পারতো। তাছাড়া চলচিত্র এবং সমাজব্যবস্থা থেকেও অপরাধের পাঠ নিচ্ছে কিশোর-তরুণরা। অনুকরণের মাধ্যমেও অনেক অপরাধ ঘটছে। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দুর্বল হলে কিশোর মন খুব দ্রত অপরাধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আবার কিশোর বয়সে অপরাধ করলেও আইনে তাদের কঠোর শাস্তি প্রয়োগের বিধান নেই। অপরাধ প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বে থাকা লোকদের সঙ্গে ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের আয়ে ভাগ বসানোর জন্য অপরাধীদের এক ধরনের অনাকাক্সিক্ষত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, গ্যাং কালচারের সঙ্গে বাঙ্গালীদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি ইউরোপীয় কালচার। প্রযুক্তির কারণে সেটা আমাদের সংস্কৃৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। কয়েক দশক আগেও মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গ দিতেন, সময় ও পরিস্থিতির কারণে এখন সেটা সেভাবে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না ফলে সন্তানরা অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। সঙ্গ খোঁজতে গিয়ে অনেক সময় খারাপ সঙ্গীর সঙ্গে মিশে যায়। এছাড়া শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ থেকে যে নৈতিকতার শিক্ষা পেত সেটাও এখন পাচ্ছে না। তাছাড়া ১৯৯০-এর দশক থেকে দেশে ব্যাপক গতিতে নগরায়ন হচ্ছে। দলে দলে মানুষ শহরে আসার কারণে শহরের সমাজব্যবস্থায় একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, যার কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক মূল্যবোধ। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়াতে শিশু-কিশোরেরা পারিবারিক মমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া পরিবর্তনশীল সমাজে হয়তো অনিবার্য বিষয়, কিন্তু তার বিকল্প আমরা বের করতে পারিনি। আর আমাদের শহরও এমন কদাকার, যেখান থেকে রিফ্রেসমেন্টের জায়গাগুলে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে পাড়ার ছেলে-বুড়োদের একত্র হওয়ার অবকাশ নেই। 

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাহির হয়ে আসতে হলে সরকারের পাশাপাশি আমাদের করণীয়সমূহ-  
পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ইতিবাচক পদক্ষেপ ও স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ ছাড়া গ্যাং কালচার রোধ করা সম্ভব নয়। কিশোর অপরাধ দমনে শুধু আইন প্রয়োগই নয় সামাজিক সচেতনতা জরুরী। সমাজের মানুষের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন না এলে বা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না হলে এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। শিশুর সামাজিকীকরণ বা শিক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। তাই এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মা-বাবাকে সন্তান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কোথায় সময় কাটাচ্ছে, সে বিষয়ে মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে। দিনে একবার হলেও পরিবারের সবাই এক টেবিলে বসে খাবার খেতে হবে। এতে ভাবের আদানপ্রদান হয় ও সন্তানদের চাহিদা সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হয়। সন্তান কার সঙ্গে মেশে-এ বিষয়ে মনিটরিং করতে পারলে গ্যাংয়ের মতো বাজে কালচারে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই  অভিভাবকদের উচিত, সন্তানদের সময় দেয়া; সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে আরও জোরদারকরণ; স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কাউন্সিলিং। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আরও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহন; শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্তকরণ; পাঠ্যসুচির বাইরের শিশুদের মধ্যে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিকরণ; খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক পরিসর বৃদ্ধিকরণ; শিক্ষার্থীদের শাসন করার ক্ষমতা স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের উপর অধিকতর ন্যাস্তকরণ; অভিবাবক-শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক উন্নয়ন; শিক্ষকদের জবাবদিহিতার জায়গাটা আরো সুদৃঢ়করণ; শিক্ষণ-শিখন পরিবেশ নিশ্চিতকরণ; মনিটরিং ও পর্যবেক্ষন ব্যবস্থা জোরদারকরণ, সমাজে সিনিয়রদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন; শালীন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান, স্কুল ও পরিবারের মাঝে সেতুবন্ধন স্থাপন; কিশোর অপরাধ রুখতে ছিন্নমূল শিশু-কিশোর বা অভিভাবকহীন ও পথশিশুদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ গ্রহণ, ইত্যাদি।  

অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, 'সামাজিক যে টানাপড়েন তৈরি হয়, তারই একটা অংশ গ্যাং কালচার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিশোর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা। আইনের ভয় দেখিয়ে অপরাধ স্থায়ীভাবে দমন করা যায় না, একমাত্র নীতি নৈতিকতা দিয়েই অপরাধ দমন করতে হয় । শিশু-কিশোরদের নৈতিক শিক্ষার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা ক্রমশঃ নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে আসছে বলেই তাদের একটা অংশ আজ বিপথগামী হয়ে পড়েছে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার অনুসঙ্গ যুক্ত করা খুবই প্রয়োজন। প্রত্যেক পিতা-মাতারই উচিত ছোটবেলা থেকেই তাঁদের সন্তানদের পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ রেখে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় এবং নৈতিক-অনৈতিক বিষয়ে স্বচছ ধারণা দেয়া। সমাজের মানুষের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন না এলে বা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না হলে এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।  তাই কিশোর গ্যাং কালচারসহ অন্যান্য সামাজিক সমস্যা দূর করতে-পাঠ্যপুস্তকে ধর্মশিক্ষা পালনের সুযোগ দেয়া এবং-বিদেশী অপসংস্কৃতির প্রবেশের পথ বন্ধ করা উদ্যোগ নেয়া। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে কিংবা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুচর হিসেবে কাজ করছে অনেক কিশোর। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজনৈতিক বড় ভাইদের ছত্রছায়ায় থেকেই কিশোর গ্যাংগুলো তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচেছ। কিশোর অপরাধীরা তাদের রাজনৈতিক বড় ভাইদের কাছ থেকে কী কী সুবিধা পান সেটা পুলিশ বাহিনীর অজানা নয় । এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রত্যেক মা-বাবাকে তার সন্তান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বখে যাওয়া সন্তানকে সুপথে আনার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ছাত্র ও ঝরেপড়া সব কিশোর সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে পিতামাতা, অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনদের বাড়তি পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। 

এ পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত প্রশাসনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক উদ্যোগ নেয়া জরুরি। পুলিশী অভিযান ও টহল জোরদার করার পাশাপাশি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ ও সচেতনতা কর্মসূচি থাকলে, একইসঙ্গে পরিবারের অভিভাবকদের ইতিবাচক ভূমিকা থাকলে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সাফল্য আসবে। আমাদের বিশ^াস, সম্মিলিতভাবে চেষ্টা নিলে কিশোর গ্যাং নামক দুষ্টক্ষত থেকে সমাজ ও দেশ মুক্ত হবে। সবশেষে বলব, কিশোর গ্যাং কালচাররোধে সরকার এবং অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই সচেতন হতে হবে। 

লেখক : অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), ঢাকা।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043787956237793