দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘবদ্ধ হয়ে কিশোররা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। পটুয়াখালী জেলায়ও এ ধরনের একাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। কথিত ‘বড় ভাইদের’ আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা হয়ে উঠেছে ভয়ংকর।
ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধ দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তারা ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হানাহানি, মাদক সেবন ও মাদক কেনাবেচাসহ কুপিয়ে জখমসহ খুনের ঘটনাও ঘটাচ্ছে। কিশোরদের এ ভয়ংকর রূপ ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশকে। চিন্তিত অভিভাবকরাও।
পটুয়াখালী জেলায়ই ‘হাসান-হোসেন’, ‘তরু,’ ‘আশিক,’ ‘শিমু’, ‘বাপ্পী-হিমেল’ ও ‘ভাইয়া’সহ অন্তত ১০টি গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে। মঙ্গরবার (০৫ আগস্ট) যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জান যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিলাস দাস।
কথা হয় পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মোহম্মদ মইনুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিশু এবং কিশোর অপরাধ এবং কিশোর গ্যাং দমনে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এ গ্যাং নিয়ন্ত্রণে সমাজকে আরও সচেতন হতে হবে। এ জন্য অভিভাবকদের সচেতনতা এবং সহযোগিতা দরকার। তা হলেও শিশু-কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব।শহরের ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ‘হাসান-হোসেন’ আলোচিত নাম। দুই ভাইয়ের নামেই এ বাহিনী। বাবা-মার দেয়া নাম মেহেদী হাসান ও ইমরান হোসেন। শহরের তিতাসপাড়ার ঋষি বাড়ির সন্তান হাসান-হোসেনের নেতৃত্বে সক্রিয় গ্রুপের কর্মকাণ্ড পটুয়াখালী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও তার আশপাশ এলাকা ঘিরে।
সম্প্রতি স্থানীয় নির্বাচনের জের ধরে ১৯ জুন হিমু সিকদার (২০) নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে জখম করে এ বাহিনীর সদস্যরা। থানায় মামলা হলেও এ বাহিনীর দুই প্রধান এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাকি আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ফের মাঠ চষে বেড়াচ্ছে।
এর আগে ৩ মে চাঁদা না দেয়ায় ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে নুরুজ্জামান তালুকদার (৩৫) নামে এক ব্যবসায়ীর বাঁ-পা ভেঙে দেয়। নুরুজ্জামান এখন পঙ্গু। শুধু তাই নয় মামলা না তোলায় ‘হাসান-হোসেন’ বাহিনীর সদস্যরা তার স্ত্রী তানিয়া বেগম এবং বৃদ্ধা মাকে পিটিয়ে আহত করে।
মামলা না তোলায় সম্প্রতি দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত নুরুজ্জামানের অফিসে হাজির হয়ে তার প্রাণনাশের হুমকি দেয়। পুলিশ তাদের কয়েকজনকে ধরে জেলে পাঠালেও পরে তারা জামিনে বেরিয়ে বীরদর্পে আগের অপকর্মে লিপ্ত হয়।
এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সদর থানায় একাধিক জিডি ও মামলা থাকার কথা স্বীকার করেছেন সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান। থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, এ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলেই রাজনৈতিক চাপ আসে।
এর আগে ছাত্রলীগের সাবেক একজন নেতার ছত্রছায়ায় এরা কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলেও বর্তমানে ছাত্রলীগের একজন নেতার ছত্রছায়ায় রয়েছে এরা। জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হাসান ও সম্পাদক ফারুক জানান, না এ বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই।
এ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মাদক কেনাবেচার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে বলে পটুয়াখালী পলিটেকনিক ইন্সটিউটের শিক্ষার্থীদের অনেকেই স্বীকার করেছেন। সদর থানার এসআই মেহেদী হাসান বলেন, একটি সন্ত্রাসী মামলায় এ বাহিনীর একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে গত মাসে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।
পটুয়াখালীতে অনেকের কাছে আতঙ্কের নাম ‘শিমু’ বাহিনী। কলাপাড়ার টিয়াখালীর ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান শিমুর (৩৭) নেতৃত্বে গঠিত এ বাহিনীর সামনের সারিতে রয়েছেন শামীম, শাখাওয়াত ও মাইনুল। এরা ৩০ জুলাই কলেজ পড়–য়া ছাত্র মনিরুলকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে।
তাকে কোপানোর পর তারা অস্ত্র উঁচিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এ ঘটনা পটুয়াখালীতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কলাপাড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, ওই মামলায় শাখাওয়াতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
একটি সূত্র বলছে, জেলার মাছে ঘের নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও স্থানীয় জমি-জমা, স্লুইস গেট ও চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই যত হানাহানি। পুলিশ বলছে, স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির পোষ্য পুত্র হওয়ায় সে অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ বাহিনীর ৩০-৩৫ সদস্য বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে। শিমু বাহিনীর ডান হাত হিসেবে পরিচিত কালা মিরাজের বিরুদ্ধে গত বছর নারী পর্যটক খুনের ঘটনায় ঝালকাঠি থানায় মামলা হয়েছে। এছাড়া শিমু বাহিনীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও এক বাস শ্রমিককে মারধরের অভিযোগে থানায় মামলা হলেও পরে তা মীমাংসা করা হয়। জানতে চাইলে শিমু যুগান্তরকে জানান, আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ মিথ্যা।
তাছাড়া বাস শ্রমিককে মারধরের বিষয়টি-তো মীমাংসা হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাই না। এটা “জিকু-খালিদ” বাহিনীর কাজ। কলাপাড়া উপজেলায় আরও একটি গ্যাংয়ের নাম ‘আশিক বাহিনী’ অতি সম্প্রতি পৌর মেয়রের বাসায় সামনে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আলোচনায় আসে এ বাহিনী। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পায়রা বন্দর এলাকাকেন্দ্রিক তাদের বিচরণ। পটুয়াখালীতে সক্রিয় আরও একটি বাহিনীর নাম ‘তরু’।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তরিকুল ইসলাম ‘তরু’র নেতৃত্বে দাবড়ে বেড়ানো এ বাহিনীর সদস্যরা ২০১৪ সালে ভয়ংকর হয়ে উঠে। নানা অপরাধমূলক কাজের ধারাবাহিকতায় এ বাহিনীর হাতে খুন হন নাসির নামে এক ইউপি সদস্য।
পরে ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই র্যাবের সঙ্গে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হয় এ বাহিনীর প্রধান ‘তরু’। তরুর অন্তিম যাত্রাও রাজনীতির অপকৌশল বলে দাবি অনেকের।
কথা হয় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি কিশোরদের অভিভাবক ও বাবা-মাকে আরও সচেতন হতে হবে।
সন্তানদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও চলা ফেরার দিকে প্রতিনিয়ত নজর রাখতে হবে। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে প্রাচীন খেলাধুলা হ্রাস পাওয়ায় সমাজে কিশোররা নানা অপরাধ করে বেড়েছে। কিশোর অপরাধ সমাজ থেকে না কমাতে পারলে ঘরে ঘরে নয়ন বন্ডের সৃষ্টি হয়ে সমাজকে স্তম্ভিত করে তুলবে।
শহরের পূর্বপ্রান্তে সক্রিয় রয়েছে ‘বাপ্পী-হিমেল’ গ্যাং। দীর্ঘদিন ধরেই এ গ্রুপটি এলাকা দাবড়ে বেড়াচ্ছে। এ গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে র্যাব সদস্যদের পেটানো, ধর্ষণ, অপহরণ, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এবং মাদকসহ সদর থানায় অন্তত দুই ডজন মামলা রয়েছে।
শহরের মোটামুটি পূর্ব এলাকাটি এ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বাপ্পীর ছোট ভাই হিমেলের রয়েছে আলাদা একটি গ্রুপ। এ দুটি গ্রুপ ক্ষমতাসীন দলের সদ্য নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির অনুসারী হওয়ায় তাদের অনেক অপকর্ম আড়ালেই থাকছে। সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বাপ্পী-হিমেল গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের ধরতে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
১৭ ফেব্রুয়ারি তুচ্ছ ঘটনায় নিখিল নামে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে ‘বাপ্পী’ বাহিনীর সদস্যরা। ওই মামলায় এ গ্রুপের কয়েক জন সদস্যকে জেলে পাঠানো হলেও কিছু দিন পর তারা জামিনে বেরিয়ে আসে।
নিখিলের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বাপ্পী বাহিনীর আতঙ্কে এখনও গোটা পরিবার। প্রভাবশালী মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত নিখিলের পরিবার মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে।
২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারিতে আধিপত্য নিয়ে সংঘাতের জেরে কলেজছাত্র মাহাবুবকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও প্রভাবশালীদের তদ্বিরে মূল আসামিদের রেহাই দেয়ার উপক্রম হলে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পিবিআইকে দেয়া হয়।
৭ জুন রাতে এ গ্রুপের কয়েকজন সদস্য শহরের বড় চৌরাস্তা এলাকায় ছিনতাই করার সময় অস্ত্রসহ পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) শেখ বিলাল হোসেনের হাতে আটক হয়। খবর পেয়ে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা ‘ছাত্রলীগ নেতা’ থানায় ছুটে গেলেও তিনি সুবিধা করতে পারেননি।
পৌর মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে জানায়, তথাকথিত রাজনীতির অপকৌশল এবং কতিপয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং কালচারের নামে ভয়ংকর সন্ত্রাসী বাহিনী।
প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এদের আশকরা না দিলেও আইনি জটিলতা থেকে বাঁচাতে তাদের ভূমিকা দৃশ্যমান। তাই এ অপরাধীদের অপকর্ম রোধ করা সম্ভব নয়। পুলিশ এ গ্যাংয়ের সদস্যদের আইনের আওতায় আনলেও রাজনৈতিক চাপের মুখে তাদের আপস করতে হয়।