রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ‘বায়তুল হিকমাহ’ গ্রন্থাগার তথা বহুমুখী প্রকাশনাটি ইতিহাসের পাতায় একাধিক নামে পরিচিত, যথা—‘খাজানাতুল হিকমাহ’ (ইবন নাদিম, ১৯৭৮ : ১৪, ১৭৪, ৩৮২-৩৮৩), ‘দারুল হিকমাহ’ (আশ শাহরুজি, ১৯৮৮ : ৫৬), ‘বায়তুল হিকমাহ’ (ইবন নাদিম, ১৯৭৮ : ১৮৪) প্রভৃতি। সোমবার (৯ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, এই নামগুলো আব্বাসীয় যুগের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারের দিকে ইঙ্গিত করে। আব্বাসীয় যুগের খলিফা হারুনুর রশিদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) ও মামুনুর রশিদ (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)-এর শাসনকালে এর প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। বায়ত-খাজানা (আলয়/আগার) শব্দটি ‘হিকমাহ’ শব্দের দিকে সম্বন্ধ থেকে বোঝা যায় এই প্রতিষ্ঠান মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্ভার নিয়ে গড়া। এর বেশির ভাগ উপকরণ অন্যান্য ভাবনা থেকে আরবিতে অনূদিত, সেদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিজ্ঞানচর্চার জন্য বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা মামুনুর রশিদ ‘বায়তুল হিকমাহ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
‘বায়তুল হিকমাহ’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত প্রথম বৃহদাকার লাইব্রেরি। আরবদের অগাস্টাসখ্যাত খলিফা আল মামুনের আমলে বায়তুল হিকমাহ গবেষণাগার, বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরি হিসেবে পূর্ণাঙ্গ জৌলুসপ্রাপ্ত হয়। (মুহাম্মদ নুরুল আমীন, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, পৃষ্ঠা : ৩৭৬)
মূলত এখানে হিকমাহ অর্থ—গ্রিক দর্শন। অবশ্য এখানে আমরা দর্শন বলতে ব্যাপক অর্থে সাধারণ দর্শন বোঝাতে পারি, যা সব ধরনের দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করে। দর্শনের বিশেষ যে অর্থ তথা চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৃতি, পরিবেশবিজ্ঞান এবং গণিতশাস্ত্রসহ অন্যান্য দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করে। মিসরের সুবিখ্যাত চিন্তানায়ক ও সাহিত্যিক আহমদ আমিনের (১৮৮৬-১৯৫৪) মতে, ‘হিকমাহ’ শব্দটি আরবরা দর্শনের সমার্থক হিসেবেই বেশি ব্যবহার করেছে। এখানে বায়তুল হিকমাহ নামকরণের ক্ষেত্রে দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি জাগতিক ও বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্ভার বোঝানোকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কারণ এই গ্রন্থাগারের বেশির ভাগ গ্রন্থ ধর্মবিষয়ক নয়, বরং বিভিন্ন জাতির দর্শন-হিকমাহ। (আহমদ আমিন, দুহাল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৬৪)
এই দিক থেকে সমকালীন বিশ্বের অন্যান্য সাধারণ ইসলামী গ্রন্থাগার থেকে এটি ছিল ভিন্ন ধাঁচের। কারণ এখানে ধর্ম ছাড়াও জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শনসহ সব ধরনের গ্রন্থকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
খলিফা মামুন ৮৩০ খ্র্রিস্টাব্দে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রে বাগদাদে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বায়তুল হিকমাহ’ (The house of wisdom)। বিজ্ঞানগৃহ নামে একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন। (Fakhry, 1983: 4/12)
আহমদ আমিন তাঁর গ্রন্থে আব্বাসীয় যুগের প্রারম্ভিক আলোচনায় বায়তুল হিকমাহ পর্যন্ত গিয়ে বলেছেন, ‘প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তৎকালীন পাঠাগারগুলোর তালিকায় ‘বায়তুল হিকমা’র নাম সর্ব শীর্ষে।
ঐতিহাসিক গবেষক ওস্তাভলি বোঁ (মৃ. ১১৩৯ খ্রি.) লিখেছেন, ইউরোপে যখন বই ও পাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, অনেক মুসলিম দেশে তখন প্রচুর বই ও পাঠাগার ছিল। সত্যিকার অর্থে বাগদাদের বায়তুল হিকমায় ৪০ লাখ, কায়রোর সুলতানের পাঠাগারে ১০ লাখ, সিরীয় পাঠাগারে ৩০ লাখ বই ছিল। অন্যদিকে মুসমানদের সময়ে শুধু স্পেনেই প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার বই প্রকাশিত হতো।
ঐতিহাসিক ইবন নাদিমের (মৃ. ১০০০ খ্রি.) মতে, বায়তুল হিকমাহ আব্বাসীয় যুগের মুসলিম শাসক হারুনুর রশিদের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বাদশাহ হারুনুর রশিদের পক্ষ থেকে বায়তুল হিকমার নির্বাহী ছিলেন আবু সাহল ফজল ইবন নুবখত (মৃ. ৮১৯) ইবন নাদিম, ১৯৭৮ : ৩৮২)। অন্যত্র তিনি উল্লেখ করেছেন, ইলান শাউবি ছিলেন হারুনুর রশিদ ও মামুনুর রশিদের পক্ষ থেকে নিযুক্ত পাণ্ডুলিপিকার।
তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার পর বায়তুল হিকমাহ সম্পর্কে এ বিষয়টি বোঝা যায় যে এটি বাদশাহ হারুনুর রশিদের আমলে প্রতিষ্ঠিত এবং মামুনুর রশিদের আমলে এর বিকাশ ও সম্প্রসারণ ঘটে এবং বৃহৎ গবেষণাগারে পরিণত হয়।
প্রাচীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে এর স্থান হিসেবে কেবল বাগদাদের নামই উল্লেখ আছে, এর বেশি কিছু পাওয়া যায় না। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, বাগদাদের রুসাফা এলাকায় বায়তুল হিকমাহ অবস্থিত ছিল। কারণ খলিফা মনসুরের (৭৫৪-৭৭৫) পর মুসলিম শাসকরা কারখের পাশে মনসুর নির্মিত শহরটি ছেড়ে রুসাফায় চলে যান। (আত তাকরীতী, ১৯৭৯: ৮/১৯৯)
আরেক সূত্র মতে, এটির অবস্থান ছিল রাষ্ট্রপ্রধানের সরকারি প্রাসাদসংলগ্ন এবং কোনোভাবেই বাইরে কোথাও নয়। কেননা বাগদাদের মানচিত্র সামনে রাখলে সেখানে কোনো পাঠাগারের দালান খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষাকেন্দ্রটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা জরুরি (ব্রোকলম্যান, তা.বি. ৪/৯১)।
মিসরীয় ঐতিহাসিক ভাষাতাত্ত্বিক জামালুদ্দিন আলী কিফতি (১১৭২-১২৪৮ খৃি.) ও অন্য গবেষকদের মতে, শামাসিয়া নামক স্থানে এ ধরনের একটি দালান ছিল (কিফতি, ১৯৬৫ : ২৩৪)। খতিব আল বাগদাদি (১০০২-১০৭২ খ্রি.) বলেন, গবেষকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় গিয়ে উল্লেখ করেছে, বায়তুল হিকমাহ বস্তুত একটি ধারাবাহিক কর্মপ্রয়াস। সুবিন্যস্ত অনেকগুলো কক্ষে চমৎকার ব্যবস্থাপনায় নিরন্তর গবেষণাকর্ম, সম্পাদনা, পাণ্ডুলিপি তৈরি ইত্যাদি কাজ চলত এখানে। নাহুশাস্ত্রবিদ ইমাম ফাররাকে (৭৬১-৮২২ খ্রি.) খলিফা মামুনুর রশিদ আরবি ব্যাকরণ (নাহু) শাস্ত্রের মৌলিক দলিলাদি সংগ্রহ ও সম্পাদনার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণার কাজে নিয়োজিত গবেষকদের যাবতীয় প্রয়োজনের দায়িত্বভার খলিফা সরকারি ব্যবস্থাপনায় ন্যস্ত করেন। (খতিব আল বাগদাদি, তারিখু বাগদাদ, ১৪/১৪৯)
প্রত্যেক গবেষকের জন্য দক্ষ সহকারী, পাণ্ডুলিপি লেখক, টীকাকার, প্রুফরিডার ও আনুষঙ্গিক ব্যয় ব্যবস্থাপক প্রভৃতি সঙ্গে দেওয়া হয়। ফলে মাত্র কয়েক বছরেই তারা গড়ে তোলেন এক বিশাল গ্রন্থভাণ্ডার। এ বিষয় সমাপ্ত করে ইমাম ফাররা ও তাঁর পুরো গবেষকদল অল্প দিনের মধ্যে আরবি ভাষার অলংকারশাস্ত্র নিয়ে কাজ শুরু করে।
বায়তুল হিকমার বিভিন্ন কক্ষে সংগৃহীত গ্রন্থ, নানা দেশের মানচিত্র, শহরের ছবি, নভোমণ্ডল ও মহাকাশবিষয়ক চিত্র প্রভৃতি রাখার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ ছাড়াও গবেষক, সম্পাদক, টীকাকার, পাণ্ডুলিপি লেখক ও তাদের সহযোগীদের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ বরাদ্দ ছিল।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন বুদ্ধি ও বিবেককে আহ্বান করেছে নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডলের সৃষ্টি ও আল্লাহর প্রকৃতির শৈল্পিক কারুকার্যে চিন্তা করার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং রাত-দিনের বিবর্তনে রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শন। যারা দণ্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত (তথা সর্বাবস্থায়) অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা করে আসমান-জমিনের সৃষ্টি সম্পর্কে আর বলে—হে আমার প্রভু, আপনি এসব অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আমরা আপনার পবিত্রতার ঘোষণা দিচ্ছি। সুতরাং আপনি আমাদের জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০-৯১)
ঠিক একইভাবে হাদিসে রাসুলেও (সা.) একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
মোহাম্মদ শফিউল্লাহ কুতুবী : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।