ভাষা যেহেতু ভাব বিনিময় ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, তাই দেশের মধ্যেই অন্তত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ফোরামগুলোতে একে অপরের সার্থক যোগাযোগের প্রয়োজনেও আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবমুক্ত একটি ভাষারীতি থাকা দরকার।
থাকুক না, বিভিন্ন জেলা/অঞ্চলে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা, তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। আর সেটা তো বদলানোও সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই; বরং সেটি আমাদের বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলা ভাষার উচ্চারণ তো বিভিন্ন হতে পারে না (যদিও ‘কলকাতার বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশের বাংলা’র এ বিভেদ ঘোচানো খুব সহজ নয়)।
রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশের বাংলা ভাষার তো একটা এক ও অভিন্ন মান বা প্রমিতি থাকা প্রয়োজন। সে জন্য অবশ্য চর্চাটা শুধু ভাষাবিশারদ বা ভাষাবিদ/ভাষা গবেষকরা করলেই চলবে না। কাজ করতে হবে অন্তত তাদেরকেও, যারা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অতিক্রম করেছেন; যদিও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমিত বাংলা বলা-লেখা শেখা বা চর্চার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেই, তবে নিজ দায়িত্বে শিখে নিতে তো কোনো বাধা নেই।
কষ্ট লাগে, যখন দেখি দেশের এমন কিছু ফোরামে/পর্যায়ে আঞ্চলিকতাদুষ্ট ভাষায় কথা বলা হচ্ছে, যেখানে সেটা কাম্য নয়। কারণ, সেখানে যারা কথা বলেন, তারা তো আদর্শ। তাদেরকে তো সবাই অনুকরণ, অনুসরণ করবে, শিখবে তাদের বচন-বাচন। কিন্তু সেসব জায়গায়ই তো বড় সমস্যা! যেমন একটি বাক্যাংশের উচ্চারণধ্বনি আমার মনে গেঁথে আছে, কানে এখনও বাজে- ‘শোংশোইদ শোদোইশ্শো’ (সংসদ সদস্য)! এটি জাতীয় সংসদের সাবেক একজন মাননীয় স্পিকারের মুখনিসৃত বাক্যাংশ। তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি- তিনি জাতীয় সংসদে, অধিবেশন চলাকালীন এটা বলতেন। আর আমার সে সময় মনে হতো, আহা, যদি পারতাম, তার কাছে গিয়ে করজোড়ে বলতাম : স্যার, বিনীত অনুরোধ, ‘সংসদ সদস্য’কে ‘শোংশোইদ শোদোইশ্শো’ বলবেন না। কারণ, তাতে হয়তো বাংলা ভাষা লজ্জা পায়, আর আমিসহ আমার মতো আরও অনেকেই কষ্ট পাই। কিন্তু কখনোই সেটা বলা সম্ভব হয়নি। বরং তারপর থেকে আরও অনেককেই এ ধরনের ফোরামে এমন অনেক ‘বাংলা’(?) ভাষাই বলতে শুনেছি, শুনে চলেছি। কিন্তু যারা বলছেন, তারা কোনোভাবেই এর জন্য দায়ী নন; দায়ী আমাদের একটি আদর্শ ভাষারীতি নির্মাণ ও নির্ধারণের সংকট।
মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, যদি সুযোগ পেতাম, বাংলা ভাষা বিষয়ক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিনীত অনুরোধ জানাতাম : ‘একটি নিয়ম করা হোক- দেশের বিশেষ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার হতে হবে। অর্থাৎ সেসব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার হবে আঞ্চলিকতার প্রভাবমুক্ত। আঞ্চলিক ভাষা থাকবে বাড়িতে, পাড়া-মহল্লা, বাজার-ঘাট থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই; সব ধরনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা, কথাবার্তা, ভাব বিনিময় ইত্যাদিতে। নিজ নিজ ভাষায় মুক্ত পাখির মতো, প্রাণ খুলে কথা বলার এই স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার অধিকার কারও নেই। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতে যেহেতু প্রায় সবই চলে নিয়মের মধ্যে (সেটা শৃঙ্খলা রক্ষা ও সৌন্দর্য সৃষ্টির স্বার্থেই), তাই এক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারটিও হওয়া উচিত পরিপাটি, শুদ্ধ।
প্রয়োজনে সেসব ফোরামের সদস্যদের জন্য শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন, যারা জাতীয় সংসদে যাবেন, অর্থাৎ সব মাননীয় সংসদ সদস্যকে প্রথম অধিবেশন শুরুর আগেই যেমন শপথ নিতে হয়, তেমনি ‘শুদ্ধ বাংলা বলা’ বিষয়ে একটি নিবিড় অবহিতকরণ কর্মশালা/ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা থাকতে পারে। এ ওরিয়েন্টেশনে মাননীয় সংসদ সদস্যদের শেখানো হবে খুবই মৌলিক কিছু শব্দ, যেগুলো ভুল উচ্চারণ করলে কানে খুব লাগে। শুরুতে এ ধরনের ওরিয়েন্টেশনের প্রস্তাব দেয়া বা এতে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে জড়তা আসতে পারে, কিন্তু এটা যখন নিয়মে পরিণত হবে, তখন এই ওরিয়েন্টেশনে অংশ নিতে আর জড়তা বা লজ্জার কিছু থাকবে না।
একইভাবে প্রত্যাশা- যারা টেলিভিশনে কথা বলবেন (টক শো, সাক্ষাৎকার, উপস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে) অথবা সংবাদ পড়বেন, কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে মাঠ থেকে রিপোর্ট পড়বেন ইত্যাদি ক্ষেত্রে উচ্চারণের ভুল বা আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্টতা অমার্জনীয় হিসেবে গণ্য করা হবে। অর্থাৎ তাদেরকেও ওরিয়েন্টেশনের আওতায় আনতে হবে। কোনোভাবেই তাদের উপস্থাপনা ততক্ষণ পর্যন্ত জনসমক্ষে উপস্থাপিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা মোটামুটি নির্ভুল/মানসম্মত না হয়। উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে প্রমিত বলা ও লেখা নিশ্চিত করতে পারলে, ধীরে ধীরে তা আমাদের মতো সর্বসাধারণের মধ্যেও অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর তখনই প্রমিত চর্চার ক্ষেত্রটি প্রসারিত হবে।
একটি শব্দ অনেকেরই জানা- ‘বাংলিশ’ বা ‘বাংরেজি’। অর্থাৎ বাংলার সঙ্গে ইংলিশ/ইংরেজির মিশ্রণ ঘটালে, মানে বাংলা+ইংলিশ=বাংলিশ বা বাংলা+ইংরেজি=বাংরেজি। আমার কাছে মনে হয়, এই দূষিত রীতির নামকরণটির নিগূঢ় উদ্দেশ্যটি আসলে ‘বাংলিশ’ বা ‘বাংরেজি’ ভাষায় কথা বলা ব্যক্তিদেরকে ভদ্রোচিতভাবে উপহাস করা (যদিও আমরা, ব্যবহারকারীরা, বুঝে না বুঝে কিংবা সীমাবদ্ধতার কারণে সেই উপহাসের তোয়াক্কা করি না; যেমন এ লেখাটিতেও আমি অনেকটা সীমাবদ্ধ হয়েই ‘বাংলিশ’ থাকলাম)। এ ‘বাংলিশ’ বা ‘বাংরেজি’ এখন ক্রমেই ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে (যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর একটা ‘স্মার্ট’ গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে)। ঠিক একইভাবে ছড়িয়ে পড়ছে প্রমিত বাংলার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ! যদি কোনো অঞ্চলের ভাষা কোনো নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদিতে সংলাপের প্রয়োজনে ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে সেটাও হতে হবে শুদ্ধ আঞ্চলিক। তা না হলে, আঞ্চলিকের সঙ্গে প্রমিত মিশিয়ে শব্দ বানালে সেটা হবে ‘প্রমিতাঞ্চলিক’ (এটা আমার বানানো শব্দ)। আমার মনে হয় প্রমিতাঞ্চলিক ভাষার কবল থেকেও আমরা মুক্ত হতে চাই। কারণ, এ ধরনের বাংলা আমাদেরকে প্রকৃত বাংলা ভাষার স্বাদটা দিতে পারে না। কারণ, এগুলো এক ধরনের দূষণ। আর সেজন্যই হয়তো প্রমিত ভাষা আর আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে বললে সেই ভাষাকে বলা হয় ‘আঞ্চলিকতাদোষে দুষ্ট’ ভাষা। ঢাকায় আমার এক বন্ধুর রুমমেট (কোনো একটি বিশেষ জেলার বাসিন্দা) ‘ফুল ফোটে, পাতা ঝরে’ শব্দবন্ধ দুটো উচ্চারণ করলেন ‘পুল পোটে, ফাতা জোওড়ে’। আবার আমি যে অঞ্চলের বা জেলার, সেখানকার অনেককেই (এমনকি কোনো কোনো পদস্থ কর্মকর্তাকেও) বলতে শুনি ‘ঝরে পড়া’ (ড্রপ আউট) শব্দটির উচ্চারণ করছেন ‘ঝরে পড়া’ (ঝ+অ+রে পড়া) অর্থাৎ শুনতে অনেকটা ‘ঝড়ে পড়া’ (ঝড়ের মধ্যে পড়া)র মতো লাগে। কিন্তু এর প্রমিত বাংলা উচ্চারণ হবে ‘ঝোরে পড়া’ (ঝ+ও = ঝো + রে পড়া)। আবার কেউ ‘প্রাণ ভরে (ভো+রে=ভরে) ঘ্রাণ নিলাম’কে বলছেন ‘প্রাণ ভরে (ভ+অ+রে=ভরে) ঘ্রাণ নিলাম’।
আবার ফিরে যাই ঢাকায়, গুরুত্বপূর্ণ ফোরামগুলো দামি দামি শিক্ষিত মানুষ ‘স্মৃতিসৌধ’ (‘স্মৃতি+সৌ+ধ’) কে বলছেন ‘স্মৃতিসৌধ্’ (‘স্মৃতি+সৌধ্), ‘মঞ্চ’ (‘মন্+চো’) কে বলছেন ‘মন্চ্’ (‘মন্+চ্), ‘সাঁইত্রিশ’ (৩৭) কে বলছেন ‘সাত্ত্রিশ’, ‘সতের’ (স+তে+রো=১৭) কে বলছেন ‘সাতারো’ (সা+তা+রো=১৭), অভ্যাস (প্রমিত উচ্চারণ : ও+ভ্যা+স=অভ্যাস) কে বলছেন অভ্যাস (অ+ভ্যা+স=অভ্যাস), ‘সম্মান’ (স+ম্+মা+ন্) কে বলছেন ‘সম্মান’ (স+ন্+মা+ন্)। সম্প্রতি এক মোবাইল অপারেটরের বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে ঝড়ো (ঝ+অ+রো=ঝড়ো) অফার; আসলে হবে ঝোড়ো (ঝ+ও+রো=ঝোড়ো) অফার। এক রাজনীতিবিদকে (একটি বড় দলের দলীয় প্রধানের উপদেষ্টা) টক শোতে প্রায়ই বলতে শুনেছি তিনি ‘হরতাল’কে (উচ্চারণ হবে র্হ+তাল্) বলছেন হ র তাল (হ+র+অ+তাল)। এমনকি যে শব্দগুলো তাদেরকে প্রতিনিয়তই উচ্চারণ করতে হয় সেরকম শব্দ ‘নেতা’কে বলছেন ‘ন্যাতা’ আর ‘দেশ’কে বলছেন ‘দ্যাশ’। অবশ্য বলা প্রয়োজন, রাজনীতি করতে বা বড় নেতা হতে শুদ্ধ বা প্রমিত বাংলাভাষী হওয়ার প্রয়োজন নেই (কারণ, অনেকেই মনে করেন, বরং আঞ্চলিক ভাষা নিয়েই গণমানুষের বেশি কাছে যাওয়া যায়)। কিন্তু যাদেরকে গণমানুষের অত কাছে যেতে হয় না; বরং গণমানুষসহ সব ধরনের মানুষই তাদের মুখ থেকে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ প্রত্যাশা করেন (কেউ কেউ হয়তো করেনও না), তাদের তো অন্তত শুদ্ধ/প্রমিত বাংলা উচ্চারণই করা উচিত।
রংপুর অঞ্চলে ‘আমি’কে ‘মুই’, নোয়াখালী অঞ্চলে ‘পানি’কে ‘হানি’ অথবা চাঁটগাঁ অঞ্চলে ‘কী করছে’কে ‘গী গোইজ্জে’ বললে এগুলো কি শুদ্ধ হবে না? অবশ্যই হবে; তবে তা শুদ্ধ বাংলা ভাষা নয়, তা হবে শুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষা অথবা শুদ্ধ আঞ্চলিক বাংলা ভাষা। অবশ্য টেলিভিশন নাটক-সিনেমাতে মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায় ভুল উচ্চারণ ও ভুল সুরে আঞ্চলিক ভাষা বলা হচ্ছে। আমার মতে আঞ্চলিক ভাষার আনুষ্ঠানিক ব্যবহারেও একটি প্রমিতিবোধ বা শুদ্ধতা থাকা উচিত।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত রেকর্ডকৃত দুটো টিভি অনুষ্ঠানে (২৪ মে এবং ৩১ মে ২০১৫, বিটিভিতে সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে প্রচারিত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপকের উপস্থাপনা থেকে দু-একটি শব্দ তুলে ধরছি: ‘সোমাজ বিজ্ঞানের সোংজ্ঞা’, ‘সোংখ্যা’ ইস্ট্রং (স্ট্রং), ‘সোমাধান’, ‘সোমাহার’, ‘সোংগোবদ্ধ’, ‘সোম্প্রদায়’, ‘সোংগঠন’, ‘সোম্পাদন’ ইত্যাদি। আমি জানি না, যারা শিক্ষানবিশ, এসব উচ্চারণ তাদেরকে কী বার্তা দেয় বা তারা এসব উচ্চারণ থেকে কী শিখবে।
আমার মতে, সর্বত্র না হোক, অন্তত সুধী সমাজের আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতে প্রমিত বা মান বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ, সুধী সমাজের আনুষ্ঠানিক উচ্চারণগুলো হবে আমাদের মডেল; আমাদের সবাই, বিশেষ করে শিশুরা তো সেখান থেকেও শিক্ষা নিয়ে, প্রমিত বা মান বাংলায় কথা বলা শিখবে। আরও ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে, রক্তে কেনা বাংলা ভাষার মান।
লেখক : ছড়াকার ও সংস্কৃতিকর্মী
সূত্র: যুগান্তর