কৈশোর বা তারুণ্য জীবন প্রসরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বয়সসীমা ১৩ থেকে ১৮ বছর। সাধারণ কথায় এদের টিন এজার বলা হয়। এ বয়সে ছেলেরা বাবা হওয়ার এবং মেয়েরা মা হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। এ সময়ে কিশোর কিশোরীরা মানসিক, আবেগীয়, সামাজিক এবং দৈহিক দিক থেকে পরিপক্কতা অর্জন করেছে। এরা একই বয়সের ছেলে মেয়েদের সাথে নতুন সুসম্পর্ক স্থাপন করে, স্ত্রী-পুরুষের সামাজিক ভূমিকা পালন করে, নিজের দৈহিক গঠন মেনে নিয়ে এর যথাযথ প্রয়োগ করে, মা-বাবা ও বড়দের অযাচিত স্নেহ-ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে রাখে।
মানসিক স্বাস্থ্য
মন হলো অদৃশ্য গতিশীল সত্ত্বা বা শক্তি যা আমাদের পরিচালিত করে। আমরা যেভাবে দেহের গুরুত্ব দিয়ে থাকি সেভাবে মন নিয়ে চিন্তা করি না। পূর্ণ সুস্থতার জন্য দেহ ও মনের সুস্থতা অতীব জরুরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে “স্বাস্থ্য হলো এমন এক অবস্থা যা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা এই তিনটিকে একত্রিত করে সম্পূর্ণতা পায়”। সুতরাং সুস্থতার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে, “মানসিক স্বাস্থ্য বলতে এমন অবস্থাকে বোঝায় যেখানে ব্যক্তি তার ক্ষমতাকে প্রয়োগ করতে পারে, জীবনের চাপমূলক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে তার কাজগুলো হয় উৎপাদনমুখী ও কার্যকর এবং সে সমাজের জন্য অবদান রাখতে সক্ষম”।
মানসিক স্বাস্থ্যের লক্ষণ
কিশোর-কিশোরী তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে;
- এরা আশাবাদী থাকে এবং হতাশাকে জয় করতে পারে;
- প্রতিদিনের কাজে তারা আনন্দ পায় এবং জীবনকে অর্থপূর্ণ মনে করে;
- তারা তাদের ক্ষমতা ও বুদ্ধির সঠিক প্রয়োগ করতে পারে;
- তারা আত্মবিশ্বাসী বাস্তবধর্মী এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়;
- এরা বেশি সময় একা থাকে না, পরিবার ও সমাজের অন্যদের সাথে মিলে-মিশে থাকে;
- কোনো ধরণের অপরাধে জড়ায় না এবং মামলা-মোকদ্দমা এড়িয়ে চলে;
- এরা মাদকাসক্ত নয় এবং যৌন বিকৃতি নেই;
- এদের ধৈর্য্যশক্তি বেশি থাকে এবং মানুষকে ভালোবাসে;
- মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী কিশোর-কিশোরী তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম। যেমন, রাতে পরিমিত ঘুমানো, সময়মত খাবার খাওয়া;
- সবচেয়ে বড় কথা এদের কোনো দীর্ঘ মেয়াদী অসুস্থতা থাকে না।
মস্তিস্কের কার্যকলাপ
স্নায়ু মনোবিজ্ঞানীদের মতে কারো কারো ক্ষেত্রে মস্তিস্কের গঠন সম্পূর্ণ হতে ২৪ বছর লেগে যায়। তাই এদের নিকট বাস্তবতার চেয়ে অনেক সময় আবেগই বড় হয়ে দেখা দেয়। কিশোর-কিশোরীরা নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এগিয়ে যায়। ভবিষ্যতের চিন্তা না করে দ্রুত ফলাফল পেতে চায়। কেউ কেউ ধূমপান করে বা কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এদের অনেকেই কথায় কথায় মেজাজ দেখায়, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখে, অসম্ভব জোরে গান শুনে, পড়ালেখায় মনোযোগ থাকে না। মা-বাবার বিচ্ছেদ বা পারিবারিক সমস্যা, শিক্ষকের অবহেলা, ইন্টারনেটের খারাপ প্রভাব এসবের কারণেও তারা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে।
মনের যত্ন গুরুত্বপূর্ণ
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যারা অনেক দিন পর্যন্ত সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকেন তাদের জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত বিষয়গুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। মানসিক সুস্থতা বার্ধক্যেও অন্যের উপর নির্ভরশীরতা কমিয়ে আনে। আমাদের বয়স মনের সাথে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পায়। তাই প্রকৃত বয়স যাই হোক না কেন বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি সবার এক রকম নয়। যারা খুব বেশি অন্যের সমালোচনা করে, অন্যকে সারাদিন উপদেশ দেয়, যাদের জীবনে কোনো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থাকে না তারা দ্রুত বার্ধক্যে উপনীত হতে পারে।
করণীয়
যে কোন কিশোর-কিশোরী বর্তমান সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। আর এ অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য সবার আগে প্রয়োজন পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া এবং হতাশ না হয়ে আশাবাদী থেকে রুটিন মাফিক জীবনকে চালনা করা এবং শরীরচর্চার অভ্যাস রাখা। মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী কিশোর-কিশোরী ইতিবাচক কাজ দিয়ে দিবসের সূচনা করে। যেমন, প্রার্থনা দিয়ে দিনের সূচনা করা, সকালে সময় মত নাস্তা করা, আনন্দের সাথে দিনের কার্যক্রমে (লেখাপড়া) অংশ নেয়া, সময়মত দুপুরের খাবার গ্রহণ করে বিকালে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা, সন্ধ্যার পর আবার নিজের কাজ (লেখাপড়া) সম্পন্ন করে সময়মত রাতের খাবার খেয়ে ইতিবাচক চিন্তার পর পরিমাণ মতো ঘুমিয়ে নেয়া। দিনের অধিক ঘুমে মানসিক সুস্থতার ঘাটতি দেখা দেয়। রাতে মোবাইল, ফেইসবুক থেকে দূরে থাকা মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
এ সময়ে বাবা-মাকে সন্তানের পাশে থাকতে হবে। নিজেদের মতকে তাদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে তাদের মতামত বোঝার চেষ্টা করতে হয়। তাকে ভালো কাজে উৎসাহ দিতে হবে এবং বুঝাতে হবে জীবনে চলার পথে শর্ট কোনো রাস্তা নেই। চেষ্টার পরেই আসবে সাফল্য।
সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মেধার প্রয়োগ করে অচিরেই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবো এই কামনা করি।
লেখক: প্রফেসর মোঃ আমিনুল হক, অধ্যক্ষ ও মনোবিজ্ঞানী, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ, ঢাকা