ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ক’ ইউনিটের ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ১৩ দশমিক ০৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে; ফেল করেছে প্রায় ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার এই বাস্তবতা রীতিমতো হতাশাজনক। শুধু এবারই নয়, গত কয়েক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ‘মেধাবী’দের বেশিরভাগই পাস নম্বর পাননি। ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকেন হাল সময়ের সেরা ছাত্রছাত্রীরা। কাজেই সার্বিক পরিস্থিতি দেশের শিক্ষা পদ্ধতির গুরুতর সংকটকেই প্রকাশ করে।
গত কয়েক বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাচ্ছিল। সর্বাধিক জিপিএ-৫, সর্বাধিক পাস, সর্বাধিক গোল্ডেন ফাইভ ইত্যাদি। তখনই শিক্ষাবিদসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে ‘ভালো’ ফলের এই পরিমাণগত বৃদ্ধি কি শিক্ষার গুণগত মান বিসর্জনের বিনিময়ে অর্জিত হচ্ছে? এখন দেখা যাচ্ছে, সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করা হয় না, শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা দৌড়াচ্ছেন কোচিংয়ের পেছনে। শিক্ষকরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পড়ান কোচিংয়ে। কোচিং নির্ভর শিক্ষার যে পরিণতি হওয়ার কথা ঠিক তাই হচ্ছে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায়। দেশের শিক্ষার ভিত্তি ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা আর হতে পারে না।
কোন জাতিকে বিনা যুদ্ধে ধ্বংস করতে হলে তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করাই যথেষ্ট। এমনটা অন্য কেউ করছে, তা আমরা মনে করছি না। সম্ভবত আমরা নিজেদের অজান্তেই এ আত্মবিনাশী পথ বেছে নিয়েছি। সরকার মানসম্মত শিক্ষার চেয়ে পাসের হার বৃদ্ধিতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে মন দিয়ে পড়াশোনা না করেও শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিকে আশাতীত সাফল্য পাচ্ছে। শিক্ষাদান ও পাবলিক পরীক্ষায় যত্নশীল না হয়ে ‘উদার’ হওয়ার কল্যাণে ফলাফল ভালো হয়। এসব ছাত্রছাত্রীর একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। ভুরি ভুরি এ প্লাস কীভাবে হয় তা সবাই জানেন। এ প্লাসের এই মহোৎসব থামানো খুবই জরুরি।
স্কুল-কলেজের কোন কোনটিতে ভালো লেখাপড়া হয়। আবার অনেকগুলোতে তেমন কিছুই হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ স্কুল-কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা কোচিং সর্বস্ব হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে মাদরাসার পশ্চাৎপদ শিক্ষা পদ্ধতিকে কোন রকম বাছবিচার ছাড়াই শিক্ষার মূল স্তরে ঢোকানো হয়েছে। এ অবস্থায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা কীভাবে ন্যূনতম গুণগত মান অর্জন করবে সেটাই প্রশ্ন?
আমরা মনে করি, এবার অন্তত শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অভিভাবক তথা সমাজের টনক নড়া উচিত। উচ্চ পাসের হারের বিপরীতে নিম্নমানের শিক্ষা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকেই পরিহাস করছে। এ বাস্তবতা শিক্ষা দফতর, শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষক মহল এবং অভিভাবকদের ব্যর্থতারই যোগফল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দায়ী হলো সেসব শিক্ষার্থী, যারা বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার অসহায় শিকার। অথচ তাদেরই আজ দুর্ভাগ্যের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে দেশের সেরা শিক্ষাবিদদের নিয়ে কমিশন গঠন করে করণীয় ঠিক করা উচিত। উচিত সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করে ঢেলে সাজানো। সবচেয়ে বেশি দরকার হলো শিক্ষা খাতে সরকারের উদার বিনিয়োগ। সেই সঙ্গে সদিচ্ছা, সঠিক কর্মপন্থা ও দূরদর্শিতা একান্ত প্রয়োজন। মূল কথা হচ্ছে কোচিং নির্ভরতা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের ব্যবস্থায় উন্নীত করতে হবে।
সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ