ধৈর্য, সহ্য দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে দিনদিন। সমাজের বয়স্করা প্রায়ই বলেন কথাটা। এর বাস্তব সত্যতাও আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত পরিলক্ষিত হচ্ছে। অন্যদিকে বলা হয়, শিক্ষার চূড়ান্ত ফল হচ্ছে সহনশীলতা। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার হার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে (বর্তমানে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ ভাগ)। তাহলে অসহনশীলতার মাত্রা দিনদিন বাড়ছে কেন? এর কারণ একটাই, আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছি না। পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে নানা মন খারাপ করা খবর। আজকেই পড়লাম একজন লোক তার মা ও ছোটভাইকে গলা কেটে খুন করেছে, কখনো ছেলে বাবাকে খুন করছে, রাজনৈতিক বিরোধের কারণে গুম, হত্যা এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা।
একটা গণতান্ত্রিক দেশে মানুষ তার মতামত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ পাবে এটাই সকলের কাম্য। সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা হবে, নাগরিকরা তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরবে। প্রয়োজনে লেখালেখি বা রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে সোচ্চার হবে, এটাই গণতান্ত্রিক ধারা। কিন্তু গত কয়েক দিনে আমরা কী দেখলাম? যারা কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন করছে, তাদের কোনো কর্মসূচিতে যোগদান করতে দেওয়া হচ্ছে না, সংবাদ সম্মেলন করতে দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের উপর একদল বিশেষ ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা হামলা চালিয়েছে, তাদেরকে বেধড়ক পিটানো হয়েছে, তারপর পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক্ষেত্রে নির্বিকার ভূমিকা পালন করেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের মত, এখানে বিরোধীদের ইন্ধন রয়েছে। জামায়াত-শিবিরের সক্রিয় ভূমিকার কারণে আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, এমনটাই মনে করে সরকার। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার পক্ষে এদেশের তরুণ সমাজ, কারণ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা ঠিক নয়।
সরকার ইচ্ছে করলেই এই আন্দোলন থেকে ফায়দা নিয়ে নির্বাচনের বছরে তাদের বিজয় ঘরে তুলতে পারে। কারণ দেশের এক কোটি তরুণ নতুন ভোটার হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এ আন্দোলনে অন্য বিরোধী দলগুলোর সম্পৃক্ততা থাকাকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছে না কেউই। কারণ যেখানে বিরোধী দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাঁসা করে রাখা হয়েছে, সেখানে তারা চাইবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাঁধে ভর করে কিছু ফায়দা লুটে নিতে। কিন্তু এ সুযোগ সরকার নিজেই গ্রহণ করতে পারে পরিস্থিতির যথার্থতা বিবেচনা করে। এখানে উল্লেখ্য, দেশের প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে শতকরা ৫৬ ভাগ নিয়োগ হয় বিভিন্ন ধরনের কোটা থেকে এবং বাকি ৪৪ ভাগ নিয়োগ হয় মেধার ভিত্তিতে। যেটা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটার প্রয়োগ আরো বেশি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ই এপ্রিল জাতীয় সংসদে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলেন। আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে মাত্র। এটা তাদের মৌলিক অধিকারের অংশ। সেখানে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের এমন মারমুখী ভূমিকা সত্যিই দুঃখজনক। তারা অযথা আন্দোলনকারীদের উপর চড়াও হয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলেছেন। এগুলো কী অসহনশীলতার বহিঃপ্রকাশ নয়?
আমাদের আরো সহনশীল হতে শিখতে হবে। বিকল্প মত, বিকল্প চিন্তাকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। যুক্তিযুক্ত সমালোচনা কিংবা বিরোধী মতামতকে মেনে নিয়ে নিজেদের সংশোধনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং দেশনেত্রী শেখ হাসিনার উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখে সর্বক্ষেত্রে সহনশীল আচরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু আইন দিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না, তার জন্য দরকার একে-অন্যের প্রতি সহনশীল আচরণ।
লেখক:শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়