কোটা শানিত হোক মেধায় - দৈনিকশিক্ষা

কোটা শানিত হোক মেধায়

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি অনেক দিনের হলেও নতুন উদ্যমে ৫ দফা দাবিতে আবারও আন্দোলন শুরু হয়েছে। মূলত কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য থাকা পদগুলোয় মেধায় নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করার ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন মেধাবী চাকরি প্রার্থী আন্দোলনকারীরা। চাকরি প্রার্থীদের বেশিরভাগ অংশেরই বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি রয়েছে।

ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে চাকরি পরীক্ষার ফলাফলে কোটা অনুসরণে মেধাবীরা বঞ্চিত হওয়ায় অনেক প্রার্থী রাস্তায় আন্দোলন-অবরোধ করে। এমনকি ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে কোটা অনুসরণ করে ফল প্রকাশ করায় মেধাবীরা বঞ্চিত হলে তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) ওই ফল বাতিল করে সংশোধিত ফল প্রকাশে বাধ্য হয়। বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কোটা চালু হলেও এখন এই কোটাই প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এখন মোট ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য মোট কোটা সংরক্ষিত ৩৬ শতাংশ।

কিন্তু তারা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ২.৬৩ শতাংশ। জেলা ও নারী কোটা আছে মোট ২০ শতাংশ। ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এরপরও বিভিন্ন সময় বিশেষ ধরনের কোটায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো, বিসিএস ও ব্যাংকের নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটার প্রয়োগ করার পাশাপাশি বিশেষ কোটায় পৃথক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। বিষয়টিকে নিঃসন্দেহে কোটার ভেতরে কোটা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পোষ্য কোটা, আনসার কোটাসহ সংশ্নিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক নানাবিধ ও নানামাত্রিক কোটা বিভিন্ন চাকরিতে অনুসরণ করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই মেধাবীদের বঞ্চিত করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি চাকরিতে প্রায় ২৫৮ ধরনের কোটা রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও স্থায়ীভাবে কোটা পদ্ধতি নেই বলেও ওই গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। যেসব রাষ্ট্রে কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেখানে নিয়মিতভাবে তা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না।

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু সেসব পরিবর্তনে কোটা পদ্ধতিকে আরও নেতিবাচক করে তোলা হয়েছে। পিএসসিসহ অনেক বিশেষজ্ঞ মহল বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের সুপারিশ জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। পিএসসি এই পদ্ধতিকে সহজিকরণের জন্য তাগাদা দিয়ে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছে যে, এটি অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। কোটা পদ্ধতির জটিল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শতভাগ নিখুঁতভাবে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন প্রায় অসম্ভব।

উল্লেখ্য, পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন বছরে কোটা পদ্ধতি যৌক্তিক করার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি পিএসসির অনুসরণকৃত বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির ওপর ২০০৮ সালে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ‘Quota System for Civil Service Recruitment : An Exploratory’ শিরোনামে ৬১ পৃষ্ঠার একটি গবেষণায় সংবিধান, বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা এবং অন্য দেশের তুলনামূলক অবস্থা পর্যালোচনা করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অধিকাংশ কোটাকে সংবিধান ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করেন। এমন নানা গবেষণায় কোটা পদ্ধতির দুর্বলতা উঠে এলেও কোনো এক অজানা কারণে কোটা সংস্কারের প্রশ্নটি আজও থেকেই গেছে।

নাগরিকদের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও চাকরি ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা সংবিধান লঙ্ঘনের মতো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে যে কোটা অনুসরণ করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের এই ধারণাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কোটা পদ্ধতির কারণে নাগরিকের সাংবিধানিক এ অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না। সংবিধানে সমতা ও বৈষম্য দূরীকরণের কথা থাকলেও কোটার নামে বৈষম্য চলমান রাখা হয়েছে।

তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সমান সুযোগের নিশ্চয়তার বিধান থাকলেও কোটা পদ্ধতির ফলে সেটা যথাযথভাবে অনুসরণ সম্ভব হচ্ছে না। সংবিধানে অনগ্রসর সমাজের জন্য একটি ব্যতিক্রম ব্যবস্থা হিসেবে কোটা পদ্ধতি সংরক্ষণের বিধান থাকলেও দেশের সমগ্র নাগরিকের সমান সুযোগের নিশ্চয়তাকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। কোটা পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অর্থাৎ চাকরিভেদে ভিন্ন ভিন্ন কোটা অনুসরণ করাতে এর স্বচ্ছতা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ কখনোই পিএসসির মাধ্যমে অথবা সরকারের মাধ্যমে সুস্পষ্ট গেজেট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। কোটার ফলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, যেখানে কোটার আওতায় না পড়ে তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী প্রার্থী বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব সমাজের ওপর পড়ছে, যা জাতিকে যথাযথ অগ্রসর করতে বাধাগ্রস্ত করছে।

সরকারি পদগুলোতে জনবল নিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য থাকে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণির সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার। সরকারও তার রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রেষ্ঠ মানবসম্পদ এই সংক্রান্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করে থাকে। ফলে সরকারকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কোটাসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে নাগরিকদের সুযোগের সমতার নিশ্চয়তা প্রদানসহ এর স্বচ্ছতা আনয়নের প্রশ্নটির যথেষ্ট ন্যায্যতা রয়েছে। পাশাপাশি কোটা প্রয়োগের ব্যাপকতা কমিয়ে আনা যায় কিনা সেটাও পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে যথাযথ ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়ার সময় এসেছে। জাতি-লিঙ্গ-অঞ্চল নির্বিশেষে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পৃষ্ঠপোষকতার পরিস্থিতি পর্যালোচনার মাধ্যমে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।

সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: সমকাল

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053420066833496