বাউলসাধক লালন বলেছিলেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ কিন্তু বরাবরই দেখা গেছে আমাদের দেশে নানা সংকটের সুরাহায় সরকারপক্ষ মাঠে নামে সমস্যা লেজেগোবরে হওয়ার পর। যথাসময়ে যথাসিদ্ধান্ত না পাওয়ায় সাধনায় সিদ্ধিলাভ কঠিন হয়ে পড়ে। কোটা সংকট নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্ট অস্বস্তি আজকের নয়। তখন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যখন ক্ষুব্ধতা বাড়তে থাকে তখনো পাত্তা দেওয়া হয়নি। কখনো কখনো টিভি টক শোতে কথা বলে আবার কখনো পত্রিকায় কলাম লিখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হলেও এসবকে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে।
যখন বিক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছিল তখনো সরকারের উচ্চতম স্থান থেকে করা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী শব্দচয়নে বিক্ষুব্ধ বুকের ক্ষতকে আঘাত করেছে। এর পরই এই দ্রোহ বিশাল আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। পুলিশি আঘাত ও পেটোয়া ছাত্রলীগ লাঠিয়ালদের দিয়ে গতানুগতিক ধারায় আন্দোলন দমনের চেষ্টা হয়েছে। তা সংকট বাড়িয়েছে মাত্র। তাই অসময়ে সাধনায় বসতে হয়েছে সরকারপক্ষকে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নীতিনির্ধারকরা বৈঠকে বসেছেন। এক মাস সময় চেয়ে আন্দোলন স্থগিত করার পথ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই অবস্থা পাল্টে যায়। কোটা ব্যবহার নিয়ে প্রশাসনিক ব্যাখ্যা ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ তৈরি করে। ফলাফল হিসেবে আন্দোলনে থাকা তরুণদের বড় অংশ ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
এই বাস্তবতা দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে থাকায় যা অনেক আগে থেকে টের পাচ্ছিলাম সরকারি দলের রাজনীতিক এবং প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নীতিনির্ধারকরা কেন সময়মতো গুরুত্ব দিলেন না, এ প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে। এটি তো শিক্ষার্থীদের হঠাৎ ঘোষণা নয়। বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই ছাত্ররা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। আমার এক ছাত্র প্রায় পাঁচ মাস আগে আমাকে অনুরোধ করেছিল কোটার কারণে ওরা চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছে। এ বিষয়টা নিয়ে আমি যাতে কাগজে লিখি। আমি বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।
এতগুলো মাসে নিশ্চয়ই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আরো বেড়েছে। ক্ষুব্ধ হওয়ার নানা উপাদানও যুক্ত হয়েছে। এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর পাস করা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় চাকরির সুযোগ খুবই কম। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা খুব কমছে না। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশের লক্ষ্য থাকে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়া। কিন্তু এই পথে প্রতিবন্ধকতা কম নয়। এই তো গেল বিসিএস পরীক্ষা নিয়েই বলা যেতে পারে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে। আবেদন করেছিলেন দুই লাখেরও বেশি স্বপ্নবোনা তরুণ।
নানা প্রক্রিয়া সারতেই পিএসসি ২৬ মাস সময় লাগিয়ে দেয়। জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট হয়। এরপর বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করা হয় মাত্র আড়াই হাজারেরও কম নিয়োগপ্রার্থীকে। বাকি লাখ লাখ তরুণের সামনে গভীর হতাশা। এখন এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে হতাশ তরুণরা যদি দেখেন নানা ধরনের কোটা সুবিধায় নিয়োগপ্রাপ্ত অর্ধেকেরও বেশি মেধায় পিছিয়ে থেকেও নিয়োগ লাভ করছে, তাহলে কঠিন প্রতিক্রিয়া তৈরি হতেই পারে।
আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল অন্ধকার ভবিষ্যেক আলোকিত করার প্রত্যয়ে আন্দোলন দেশজুড়ে সমর্থন পাবে। তারুণ্য ঐক্যবদ্ধ হবে। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চতম পর্যায় থেকে যদি কৌশলী বক্তব্য না আসে এবং সহানূভূতির পরশ না বোলানো হয়, তবে বিস্ফোরণ ঘটতেই পারে।
অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের এগিয়ে দেওয়ার জন্য কোটা সংরক্ষণের সমর্থন দেশের সংবিধানেই রয়েছে। তবে এর ব্যাখ্যাও রয়েছে। স্বাধীনতার অর্ধশতক শেষ হতে যাচ্ছে। এতগুলো বছরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কোটা প্রশ্নে তেমন সংস্কার দৃশ্যমান হয়নি।
একসময় নারী, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও জেলা কোটা নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল। এখন এ দেশে শিক্ষিত নারীরা সর্বক্ষেত্রে নিজ মেধাগুণে এগিয়ে আছেন। শিক্ষার প্রায় প্রতিটি স্তরের ফলাফলে মেয়েরা ছেলেদের টপকে এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের জন্যই প্রযোজ্য এমন নির্দিষ্ট পদ ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মেয়েদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করে রাখার কোনো যুক্তি আমি দেখি না। মেধাবী-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীদের কাছে এ ধরনের কোটা সুবিধা নিজেদের অবমূল্যায়ন বলেই তাঁরা মনে করতে পারেন। অন্যদিকে রাস্তাঘাটের সুবিধা ও ডিজিটাল যুগের কারণে কোনো জেলাই আর তেমন অনগ্রসর নয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সব জেলার বক্ষভূমিতে ও নাগালের মধ্যে থাকায় সব জেলার মেধাবীরা সমানতালে প্রতিযোগিতা করতে পারে। রাজধানী আর বড় বড় শহরে নানা জেলার মানুষেরই বাস। তাই সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে জেলাগুলোর জন্য ভিন্নভাবে কোটা সংরক্ষণের এখন আর অবকাশ আছে বলে অনেকেই মনে করেন না।
টিভি টক শো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়ে নানা ধরনের প্রচার-অপপ্রচার দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি। কেউ কেউ বলছেন এই প্রশ্ন তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হচ্ছে। আমি আন্দোলনকারীদের ব্যাখ্যা ও বক্তব্য শুনে তেমন নেতিবাচক কিছু দেখছি না। কোনো কোনো পক্ষের উদ্দেশ্যমূলক কিছু প্রচারণা দেখতে পাচ্ছি। বিপথগামী ছাড়া এ দেশের কোনো মানুষের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নেই—এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। সম্ভবত অতি আবেগ দেখাতে এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য অনেক রাজনৈতিক পক্ষ অতি নাটকীয়তায় নিজেদের যুক্ত করেছেন। আমি বর্তমান প্রসঙ্গ নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, কোটা বিতর্কে ফেলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বরঞ্চ অপমান করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় দেশের জন্য লড়াই করেননি। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ নানা সুবিধার ব্যবস্থা করে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছে। এখন তো দেশে নানা রকম মুক্তিযোদ্ধা আছেন। জিয়াউর রহমানও তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তিনি কি রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে হাত মেলাননি?
আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্লাস সেভেনে পড়তাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার দুই বছর জুনিয়র একজন ছাত্র পেলাম। দীর্ঘকাল পরে জানলাম সেই ছেলেটি সার্টিফিকেটধারী বড় মুক্তিযোদ্ধা। এসব মুক্তিযোদ্ধা হয়তো নিজের, পুত্র-কন্যা বা নাতি-পুতিদের জন্য নানা সুবিধা পেতে আগ্রহী হতে পারেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, স্বাধীন দেশের নাগরিকদের সঙ্গে সমানতালে চলতে না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের অনুগ্রহ বিতরণ করে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হচ্ছে। খুব প্রয়োজন পড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটা রাখা যেতে পারে।
আমার দেখা মতে, দু-একজন মুক্তিযোদ্ধা অহংবোধের কারণে এ সুযোগও গ্রহণ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সন্তানদের জন্য ভর্তির কোটা আছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত পূরণ করলে এই কোটার সুবিধা নেওয়া যায়। কিন্তু দেখেছি অনেক শিক্ষক ও তাঁদের সন্তানরা এই সুবিধা গ্রহণ করতে চান না। আমার মেয়ের ভর্তির সময়ও তা লক্ষ করেছি। ওর পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে হলে কোটার সাহায্য নিতে হতো। ও নিজেই তা বর্জন করেছে। মেধা তালিকায় সুযোগ পাওয়া বিষয়েই ভর্তি হয়েছিল।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি যুক্তিও তো অগ্রাহ্য করার নয়। একটি গেরিলা যুদ্ধ শুধু অস্ত্র হাতে যোদ্ধাদের ত্যাগেই সম্পন্ন হয় না। পাশাপাশি অনেকের সহযোগিতা ও ত্যাগেই তা পূর্ণতার দিকে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার দায়ে যাদের তিন পুরুষের সহায়-সম্পত্তি পুড়ে ছাই করে দিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা, যে মা-চাচিরা রাত জেগে অপারেশন ফেরতা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত রান্না করে স্নেহের পরশ বুলিয়ে খাওয়াতেন, যে মা-খালারা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র খড়ের গাদায় লুকিয়ে রাখতেন—সেই অপরাধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েছেন, তাঁদের হাতে তো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেই। এখন তাঁদের সন্তান বা নাতি মেধার শক্তিতে চাকরি পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে যখন দেখেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্লাস ফোরে পড়া ‘সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা’র ছেলে মেধার বিচারে অনেক পিছিয়ে থেকেও যোগ্যকে হটিয়ে দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত আসনটি অধিকার করছে, তখন ক্ষোভ তো তৈরি হবেই।
আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আবেগ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কারণে আমরা নানাভাবে সম্মান দেখিয়ে এগিয়ে দিতে পারি কিন্তু সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতায় মেধা বিচারেই জয়ীরা প্রাধান্য পাক। তাতে প্রশাসনও যোগ্য কর্মী পেয়ে আরো সপ্রতিভ হতে পারবে।
সরকারি এই সহানুভূতিটিও আমার কাছে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না। বলা হচ্ছে, নির্ধারিত কোটা পূরণ না হলে তা মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হবে। এতে কি সংকটের সুরাহা হবে? যদি কোটা সুবিধা ভোগকারীদের দিয়েই পূরণ হয়ে যায়, তখন! নাকি অভিজ্ঞতায় বলছে কোটার অনেকটাই খালি পড়ে থাকে। তাহলে তো এই সত্যটি স্পষ্ট হচ্ছে যে পিছিয়ে পড়া তরুণের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ কোটার প্রয়োজন কমে যাচ্ছে।
আমরা মনে করি, এসব যুক্তির কারণে কোটা সংস্কার অনেক আগেই করা উচিত ছিল। বৈঠকে বসে আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েও আবার কেন আন্দোলন করছে, আন্দোলনকারী একজনের কাছে আমি এ প্রশ্ন রেখেছিলাম। সে বলছিল, তারা সরকারি আশ্বাসকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এটি আন্দোলন থামানোর কৌশল মাত্র। যদি তা না হবে, তবে পুলিশের আক্রমণ কেন? ছাত্রলীগকে লাঠিসোঁটা দিয়ে নামানো হচ্ছে কেন?
আমার মনে পড়ল ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের কথা। জাতীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ভাষা আন্দোলন পূর্ণতার পথে এগিয়ে গিয়েছিল। এ সময় জাতির পিতার সফরের ধুয়া তুলে আন্দোলন স্থগিত করে পিছিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ১৯৫২ সালে জাতীয় নেতাদের দূরে সরিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছিল। বুকের রক্ত দিয়ে ভাষা আন্দোলন সফল করেছিল।
আমার মনে হয় কোটা সংকট নিয়ে যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে, তার যৌক্তিক সমাধান করতে হলে ইতিহাসের ধারাক্রম ও বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেকোনো কৌশল বুমেরাং হতে পারে। আমাদের বর্তমান সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের অনেকেই একসময় তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। দল-মত-নির্বিশেষে অভিন্ন স্বার্থের প্রশ্নে তরুণরা যখন আন্দোলনে মাঠে নামেন তখন এর গতি-প্রকৃতি কী হয়, তা তাঁদের কম জানা নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়