‘ছোট পরিবার, সুখী পরিবার’- নব্বইয়ের দশকে কিংবা এই শতকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জন্মনিরোধে উৎসাহিত করতে এটি একটি বহুল প্রচারিত বার্তা। ছোট এই বাক্যটিতে আপাত দৃষ্টিতে তেমন কোন সমস্যা না থাকলেও এতে ব্যবহৃত ‘পরিবার’ শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশের অনেক এলাকার মানুষের কাছে পরিবার মানে স্ত্রী। তারা ভেবে নিয়েছিল কম বয়েসী মেয়েদের বিয়ে করলেই বুঝি পরিবার সুখী হবে। পাঠক, এই উদাহরণ কেন টানলাম? বলছি।
চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ সারা দুনিয়া ঘুরে এবার বাংলাদেশেও পা ফেলেছে। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া আক্রান্তের সংখ্যা ২০ এবং মারা গেছেন একজন। ‘কোয়ারেন্টিনে’ আছেন অনেকেই। জ্বর, কাশিজনিত উপসর্গ থাকায় আমি নিজেও দিন পাঁচেক হল বাড়িতে একা থাকছি। বৈশ্বিক গণমাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত বিশ্বের অসহায়, মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থার খোঁজ নিচ্ছি উৎকণ্ঠ হয়ে। দেশে ও বিদেশে থাকা নিকটজনদের খোঁজ নিচ্ছি দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে। যেখানে উপমহাদেশের বাইরে থাকা আত্মীয়রা গৃহবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানে দেশে থাকা আত্মীয়দের ফোন করলেই শুনতে হচ্ছে কীভাবে তারা করোনার দিনগুলো উদযাপন করছেন! করোনা সম্পর্কে তাদের সতর্ক করতে গিয়ে জানলাম তারা কীভাবে নিজেকে নিরাপদ ভেবে হাট-বাজার, কর্মস্থল, বন্ধুসভায় নিশ্চিন্ত যাতায়াত অব্যাহত রেখেছেন।
নিজের দুশ্চিন্তার কারণে অনধিকার চর্চা করে ফেলার ভয়ে প্রিয়জনদের সাবধান করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবছিলাম কী করা যায়। ডাক্তাররা তাদের মত করে সচেতন করছেন, মানুষ নিজেদের মত করে গুজব ছড়াচ্ছে, প্রবল আত্মবিশ্বাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি কী করব? পড়াশোনা, কাজ কিছুতেই দুশ্চিন্তা কমাতে পারছি না। যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করেছি, সাংবাদিকতা করেছি। সেসব ভুলতে বসেছিলাম প্রায়। এই লেখাটি আমার বিভাগের সব অগ্রজ, অনুজ ও সহপাঠীদের উদ্দেশে, যারা গণমাধ্যমে কাজ করছেন, এ বিষয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন।
আমাদের দেশে এই ভাইরাস এসেছে প্রিয় রেমিটেন্স যোদ্ধাদের হাত ধরে। এদের কেউই কোভিড আক্রান্ত দেশ থেকে এসে ১৪ দিন আলাদা থাকা বা সঙ্গ বিবর্জিত থাকার নিয়ম পালন করেননি এবং আনন্দের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ফলে তাদের স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়রা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে। সব গণমাধ্যম, সারা দেশবাসী তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন, তারা ‘কোয়ারেন্টিনে’ যাননি বলে। সরকার, গণমাধ্যম, জনগণ সবার মুখে মুখে ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটি ঘুরছে। মানে কী এর? শব্দকোষ বলছে, এর অর্থ কোন ব্যক্তিকে পৃথক্করণ বা সঙ্গরোধ করা।
আমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় শব্দটির প্রয়োগ কখনো করতে হয়নি। আমি এর সাথে পরিচিত হয়েছি সিনেমার মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালে জলবসন্ত হওয়াতে আমাকে এক ঘরে আলাদা রাখা হয়েছিল, কিন্ত ‘কোয়ারেন্টিন’ করা হয়নি। এখন প্রশ্ন হল, বিদেশফেরতদের কতজন ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির মানে জানতেন কিংবা সঠিকভাবে জেনেছেন? যদিও আমার স্বল্পজ্ঞান দিয়ে লক্ষাধিক বিদেশ ফেরত মানুষের ইংরেজি জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত নয়। তবুও, আমাদের গণমাধ্যম কেন গণহারে এই ‘কোয়ারেন্টিন’ ব্যবহার করে যাচ্ছে? সে প্রশ্ন সাবেক গণমাধ্যমকর্মী ও যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী হিসেবে আমি করতেই পারি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগবিদ্যার পাঠ নিতে গিয়ে আমরা অনেক মডেল পড়েছিলাম, বিশ্বের বিভিন্ন দিকপালদের। আরিস্টটল, শ্যানন-ওয়েভার, হ্যারল্ড ডি ল্যাজলি, ডেভিড কে বার্লো---আরো অনেকেই আছেন। প্রথম পাঠ নিতে গেলে যে তিনটি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জানতে হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে – প্রেরক→বার্তা→প্রাপক। শুরুর এই একমুখী মডেলে মৌলিক তিনটি উপাদান দিয়ে যত সহজে যোগাযোগকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, যোগাযোগ কি অতটাই সহজ? তার ব্যাখ্যা পরের বহু সময়ে অন্য যোগাযোগবিশারদগণ বুঝিয়েছেন আরো জটিল মডেল দিয়ে। তাদের গবেষণায় জানা গেল, যোগাযোগ একমুখী নয় দ্বিমুখী। এখানে কেউ একাধারে প্রেরক আর প্রাপক নয়। একই বার্তা একাধিক মানুষের উপর ভিন্ন প্রভাব ফেলে, আসে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। কারণ মানুষের জ্ঞান, সামাজিক অবস্থা, পেশা, বয়স, লিঙ্গ, পড়াশোনা ইত্যাদি বহু কিছু মানুষকে আলাদা করেছে। গণমাধ্যমের ‘যাদুকরী বুলেট তত্ত্ব’ বহু আগেই কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। প্রেরক→বার্তা→প্রাপক এই মডেলে যুক্ত হয়েছে বহু উপাদান, বহু শর্ত। সেসব গবেষণাও বহু পুরনো। আমি এতসব গভীর আলোচনায় যাব না। এসব তথ্য গুগলেই অনায়াসে মেলে। আর আমাদের গণমাধ্যমকর্মীরা আগে থেকেই অবগত। আমি একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি কেবল।
আমাদের গণমাধ্যম কী ভাবে ধরে নিল ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটি সহজবোধ্য হবে? গণজ্ঞাপনের বার্তাগ্রাহকদের সবার জ্ঞানসীমা কি এক? যে লোকটি ইটালি থেকে আতংকিত হয়ে দেশে এসেছে সে সবার আগে বাড়ি যেতে চাইবে, প্রিয়জনদের সান্নিধ্য চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তার মুখে ‘ফাক ইয়ু সরকার’ শুনে তার ইংরেজি জ্ঞান মাপা আমাদের উচিত হয়নি। তাদের ‘কোয়ারেন্টিন’ বোঝার সময়, ইচ্ছা কিছুই ছিল না। যারা মানছেন তাদের পাড়া প্রতিবেশীরা ভীড় করে দেখতে আসছেন, এই ‘কোয়ারেন্টিন’ বিষয়টা কী? না জানি কী অলৌকিক কাজ হচ্ছে সেখানে! এরকম এক অদ্ভুত মানসিকতার জনগোষ্ঠীর জন্য ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দ ব্যবহার করে তার প্রয়োগ ও কার্যকর ফলাবর্তন আশা করার আমাদের গণমাধ্যমের বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এই আপৎকালে যেখানে আমাদের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সচেতন করা উচিত সেখানে দুর্বোধ্য শব্দের প্রয়োগ মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমসমূহের আরও একটু যত্নবান হবার সুযোগ ছিল।
গণমাধ্যমে কর্মরত বন্ধুদের অনুরোধ করব, তারা কোভিড বিষয়ক সংবাদ পরিবেশনের সময় ‘কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন’ ইত্যাদি শব্দের সহজবোধ্য বাংলা প্রতিশব্দও সাথে যুক্ত করতে ভুলবেন না।
লেখক: স্মরণিকা ধর, বিদেশী দূতাবাসে কর্মরত এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।