সাদিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবার কথা রয়েছে হাবীবের। পরীক্ষার আর মাত্র ৬ মাস বাকি থাকলেও কোনো ধরনের ক্লাস বা অনলাইনের মাধ্যমে প্রস্ততি নেই স্কুলের। হাবীব জানান, বার বার স্কুলের সাথে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এমতাবস্থায় হাবীর ও তার পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। এই স্কুলের প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নেই কোনো ধরনের অনলাইনের শিক্ষাব্যবস্থা। রাজধানী থেকে মাত্র ২৫ কিলোরমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের সাদিপুরের স্কুলগুলোর এই অবস্থা।
অন্যদিকে রাজধানী উত্তরার একটি খ্যাতনামা স্কুলের শিক্ষক শাহনাজ জানান, প্রতিদিনই তাদের অনলাইন ক্লাস নিতে হচ্ছে, সেই সাথে কোনো না কোনো টেস্ট তো আছেই। তবে তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিটি ক্লাসের জন্য তার কমপক্ষে এক জিবি ডাটার প্রয়োজন হলেও খরচটা তাকে বহন করতে হচ্ছে। শাহনাজ বলেন, তাদের শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই রাজধানীর হবার কারণে তারা শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষাথীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন। তবে বাকি ১০ শতাংশ শহরের বাইরে থাকার কারণে তাদের সাথে যোগাযোগ ও অনলাইন ক্লাস কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
প্রায় চার মাস ধরে করোনার প্রভাবে স্কুল-কলেজসহ উচ্চতর সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ আছে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দাবি করা হচ্ছে প্রায় ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীদের অনলাইনে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় দেখানো হচ্ছে, দেশে এসময় মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থীকে অনলাইনে শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
সরকারি হিসাব আর বেসরকারি সংস্থার গবেষণার একটা বিশাল দূরত্ব রয়েছে তার প্রমাণ মেলে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের শিক্ষকের বক্তব্যে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র শিক্ষক জানান, তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী থাকলেও তাদের অনলাইন শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সবপক্ষের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। করোনায় দেশে সামাজিক যোগাযোগ ব্যাপকহারে ব্যাহত হচ্ছে। এই সময়ে অনলাইনকে কাজে লাগানোর যত প্রয়োজন ছিল তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে তা অনেক ক্ষেত্রে সরকারি আদেশ হিসেবেই আছে, বস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
তিনি জানান, এ সময়ে অনলাইনের কোনো বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না।
সাদিপুর ইসলামী সিনিয়র আলিয়া মাদরাসার ছাত্র ফাহিম জানান, ফেব্রয়ারিতে তাদের দাখিল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও তার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তার সাথের ২৫ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সাথে বার বার যোগাযোগ করে কোনো ধরনের ব্যবস্থা জানতে পারেননি। এই অবস্থায় শিক্ষার্থী ও সেই সাথে তাদের অভিভাবকরা পড়েছেন বিপদে। মাত্র কয়েক মাস পর জীবনের বড় এই পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে তার রীতিমত বিপদে আছেন বলে জানান তারা। এই অবস্থায় শিক্ষাথীদের কৃতকার্য হবার বিষয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা।
একই অবস্থার কথা জানালেন নরসিংদীর মাধবীর বালুরশাহী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ রফিক। তার মতে, এই অবস্থায় গ্রামীন শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। সেখানকার এক হাজার শিক্ষার্থীর অনলাইন কোনো ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু নেই। কেবলমাত্র সাজেশন দিয়েই তারা দায়িত্ব শেষ করেছেন। করোনার প্রকোপ শুরু হবার পর থেকেই সব শিক্ষার্থী মোটামুটি অলসভাবে সময় পার করছেন। অনলাইনে পড়া চালিয়ে যাবার কথা শুনলেও এর কোনো প্রভাব সেখানে নেই। স্বাভাবিক অবস্থায় যদি এই প্রক্রিয়া চালু করা যেত তবে এই দুর্যোগের সময় দারুণভাবে কাজে দিতো। কিন্ত হঠাৎ করে অন লাইন ক্লাস চালু তেমন সুফল বয়ে আনবে না বলে মনে করেন তিনি।
আড়াইহাজারের শিক্ষক আবুল বাশার জানান, তার স্কুলে এক হাজার শিক্ষার্থী থাকলেও করোনাকালে অনলাইনে পাঠদানের কোনো সুযোগ নেই। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য রীতিমত আগামী পরীক্ষার জন্য সাজেশন দেবার বিষয়ে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।
অভিভাবকরা বলছেন, টিভি, ইউটিউব ও অনলাইনে পাঠদান উপকারভোগী ১৬ শতাংশ নাকি তা ৯২ শতাংশ সেই বিতর্ক করার সময় নেই। এখন বেশি প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ ও জীবন রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসা। তারা মনে করেন শিক্ষার্থী বাঁচলেই, বাঁচবে শিক্ষাব্যবস্থা বাঁচবে জাতি।
ভ্যানচালক ফারুক মিয়া অত্যন্ত পরিতাপের সাথে জানান, অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়ে দুটোকে পড়াচ্ছেন। করোনার কারণে মেয়েটার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া এখনো অনিশ্চিত। আগামী বছর কীভাবে ছেলেটা এসএসসি দেবে তা ভেবে দিশেহারা তিনি।
অবশ্য আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঈঙ্গিত দিয়েছেন শিগগিরই একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার। একইদিনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বব্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার উদ্বেগ কমানো জরুরি।
লেখক : শেখ নজরুল ইসলাম, উপ-সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাডটকম।