ক্লাসে ফিরছেন সেই ঢাবি শিক্ষক - দৈনিকশিক্ষা

ক্লাসে ফিরছেন সেই ঢাবি শিক্ষক

নিজস্ব প্রতিবেদক |

অবশেষে ক্লাসে ফিরছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক রুশাদ ফরিদী। তিনি অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। চলতি মাসের ৩ তারিখ ক্যান্সার আক্রান্ত প্রিয় বোনকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন ওই শিক্ষক। এর আগে ক্লাসে ফিরতে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছিলেন তিনি।

এদিকে মৃত্যুর আগে বোন রুশাদ ফরিদীকে বিভাগের সঙ্গে উদ্ভুত পরিস্থিতি মিটিয়ে ফেলার জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছিল। কিন্তু আজ ক্লাসে ফেরার সুখবরটি বোনের কানে দিতে না পেরে মর্মাহত ওই শিক্ষক। শনিবার এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি।

স্ট্যাটাসে ঢাবি শিক্ষক লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে ফেরা নিয়ে গত বেশ কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনা প্রবাহে এই নিয়ে আর কিছু লেখা লিখি করার মতন মানসিক স্থিরতা ছিল। সেই সাথে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া পারিবারিক ট্র্যাজেডীও মনের উপর একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল। সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি।

যাই হোক সব মিলিয়ে শেষ মেষ একটা ভাল খবর আছে। সেটা হলো যে আমি অবশেষে ক্লাসে ফিরছি। কাল থেকে ক্লাস শুরু হচ্ছে। মাস্টার্সের একটি ক্লাসঃ Time series analysis, কালকে সকাল এগারোটায়।

ক্লাসে ফিরে আসার এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে আমার মেজো বোন লাজুল লায়লা লুনার কথা। ও আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র ও নম্র। ও কেউ কখনো চিৎকার করে কথা বলতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। আমি খুব একটা দেখি নাই।

লুনা ( আমি বেয়াদব ছোট ভাই, বড় বোনদের নাম ধরেই ডাকি) ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রথম ব্যাচে ভর্তি হয়। তারপর অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করে। এর আগে অনার্স পাশ করে ওয়াসাতে কিছুদিন কাজ করে। এরপর একমাত্র সন্তান আরিয়ানের জন্ম হয়। আরিয়ান একজন "স্পেশাল চাইল্ড"। যার ফলে লুনার আর প্রফেশনাল ক্যারিয়ার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নাই। সন্তানের দেখা শোনাতেই তাঁর জীবনের বাকীটা অতিবাহিত হয়।

আরিয়ানের সমস্যা সমাধানের জন্য লুনা কানাডায় একটা লম্বা fসময় একা একা কাটায়। সেখানে আরিয়ানকে দেখা শোনা করে সংসারের বিভিন্ন বিষয় সামলানো অত্যন্ত কঠিন ছিল। একটা ভয়ংকর নিঃসঙ্গ যুদ্ধ সে তখন চালিয়ে গিয়েছিল। ওর হাজব্যান্ড, আমার দুলাভাই খন্দকার আসাদ উল্লাহ, যথাসম্ভব সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রায়ই গিয়ে লম্বা সময়ের জন্য থেকেছেন। কিন্তু মধ্য বয়সে এসে ওখানে স্থায়ীভাবে নতুন ক্যারিয়ার শুরুর মতন অবস্থা উনার ছিল না।

আরিয়ানের ওখানে তেমন বড় ধরনের উন্নতি না ঘটায় শেষমেষ লুনা আবার দেশে চলে আসে কয়েক বছর আগে। এর পর ভালই চলতে থাকে মোটামুটি সব কিছু। আরিয়ান স্পেশাল চাইল্ডদের একটা স্কুলে ভর্তি হলো। অনেকদিন পরে ওদের সংসারে একটা স্ট্যাবিলিটি আসল।

এরপরে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমাদের সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।

লুনার সম্পূর্ণ নিরোগ স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। তখন একটা রুটিন চেক আপ করতে যেয়ে ধরা পড়ে ওর ক্যান্সার। বিদেশে যেয়ে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা গেল যে স্টেইজ ফোর ব্রেস্ট ক্যান্সার।

এরপরের ক্যান্সারের সাথে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আর বলতে চাই না। লুনা ছিল একটা প্রকৃত ফাইটার। গত ডিসেম্বরে বিদেশে শেষবারের মতন গেল, ডাক্তার তখন তাঁকে সরাসরি বললো তোমার হাতে হয়তো একমাসেরও কম সময় আছে। আমার দুলাভাই কান্নায় ভেংগে পড়েছিলো কিন্তু ও কাঁদে নি। উল্টো সহজ স্বাভাবিক ভাবে ডাক্তারের সাথে কথা বলে চলে এসেছে।

পুরো ক্যান্সারের এই সময়টাতে নিজে এসে কখনো আমাদের এই নিয়ে কথা বলতো না। আমরা জানতে চাইলে কিছু কিছু বলতো। ওর সব রাগ অনুযোগ অবশ্য আমার দুলাভাই, আসাদ ভাইয়ের উপর ঢালতো। আসাদ ভাই শুধু ওর স্বামী ছিল না, ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধুও ছিল। আসাদ ভাই ছিল ইতিহাসের ছাত্র, ওদের একই ব্যাচ অথবা কাছাকাছি ব্যাচের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ছিল তাঁরা একে অপরের বন্ধু। শেষের দিনগুলোতে আসাদ ভাই লিটারেলি ২৪ ঘন্টা লুনার পাশে ছিল। লুনা যখন এই জানুয়ারী মাসের ৩ তারিখ, শুক্রবারে, এপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো আসাদ ভাই ওর হাত ধরে ছিল।

আমার আব্বা আমার মা কে হারিয়েছে আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে লুনা ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় সন্তান। বৃদ্ধ বয়সে এসে এই শোক সামলানো তাঁর জন্য অনেক কঠিন হয়ে গেছে।

দীর্ঘদিনের সাথী, বন্ধু আর স্ত্রীকে হারিয়ে আসাদ ভাইয়ের অবস্থা আমরা বুঝতেই পারি। কিন্তু উনার সেই শোক পালন করারও অবস্থা নাই। আরিয়ানের বয়স টিন এইজের শেষের দিকে হলেও ওর আচরণ এখনও তিন চার বছরের বাচ্চাদের মতন। শুধু সেটা হলেই হতো, কিন্তু আরো অনেক কিছু সমস্যা আছে যেটা এই ধরনের স্পেশাল চাইল্ডদের থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই আরিয়ানকে কিভাবে সামলানো যেতে পারে এটাই হয়ে গেছে উনার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যাই হোক, কারো জন্যই কিছু থেমে থাকে না, কোন না কোন ভাবেই সবার জীবন হয়তো এগিয়ে যাবে।

কিন্তু লুনার জীবন পুরোপুরি থেমে গেছে। জীবনের একটা বড় সময় সে পড়াশোনা, সংসার, সন্তান নিয়ে যুদ্ধ করেছে। জীবনের শেষদিনগুলোও কেটেছে এক দুরারোগ্য ব্যাধির সাথে সংগ্রাম করে। হয়তো ক্যান্সার জিতে গিয়েছে, কিন্তু লুনার স্পিরিট হারেনি। শেষদিন পর্যন্ত সে ভেঙ্গে পড়েনি। এক মিনিটের জন্যেও তাকে আমরা কাঁদতে দেখিনি।

লুনা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই খুবই চিন্তিত ছিল। ও প্রায়ই আমাকে বলতো একটু সবার সাথে মানিয়ে চলতে, মিটমাট করে ফেলতে। বিশ্ববিদ্যালয় আর বিভাগ আমার এই বিষয়টি আগে সমাধান করে ফেললে, আদালতের রায় চলে আসার পর যেটা উনারা চাইলে সহজেই করতে পারতেন, তাহলে হয়তো আমার এই বোনটা আরেকটু শান্তি নিয়ে চলে যেতে পারতো।

লুনা এখন কোথায় আছে জানি না, কিন্তু আমি জানি সে অবশ্যই ভাল আছে । কারণ এই পৃথিবী তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। ভাল থাকাটা তাঁর এখন অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রাপ্য।

প্রসঙ্গত, সহকর্মীদের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচারণের’ অভিযোগে ২০১৭ সালে রুশাদ ফরিদীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এর আগেও তার বিরুদ্ধে ছাত্রীর সঙ্গে ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ অভিযোগে একই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।

এর এক সপ্তাহের মাথায় ১৯ জুলাই সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট করেন তিনি। এরপর গত বছরের ২৫ আগস্ট বাধ্যতামূলক ছুটির বিষয়টি অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। তা সত্ত্বেও বিভাগে ফিরতে না পেরে ২৭ নভেম্বর থেকে একাই আন্দোলন শুরু করেন রুশাদ ফরিদী।

ওইদিন ফেসবুকে ‘আমি শিক্ষক, আমাকে ক্লাসে ফিরে যেতে দিন’ লেখাসংবলিত একটি ছবি পোস্ট করে কর্মসূচি শুরু করেন তিনি। চলমান ওই প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই পরে সিঁড়িতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিয়েছিলেন এই শিক্ষক।

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.029313087463379