‘ভয়াবহ গুজব ও গণপিটুনি থামাতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি ইমাম ও শিক্ষকদের সহায়ক ভূমিকা আবশ্যক’ এই বাক্যটি আমি আমার ও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছিলাম ক'দিন আগে। অনেকেই একমত পোষণ করে কাজ শুরু করেছেন বলেও জানিয়েছেন। তাঁদের ধন্যবাদ।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, ‘শিক্ষকদের বুঝি আর কোনো কাজ নাই?, ১০ শতাংশ কাটার সময় শিক্ষকদের কথা মনে থাকে না?, বিপদে পড়লেই শিক্ষকদের প্রয়োজন হয়?’। এসব বিরুপ মন্তব্য থেকে একটা বিষয় অনুমেয় যে, শিক্ষকদের, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির পরিমাণ কম বিধায় তাদের মনে অনেক অসন্তোষ বিরাজ করছে। সন্তোষজনক বেতন-ভাতা দিয়ে এই অসন্তোষ মেটানো জাতীয় স্বার্থেই জরুরি।
তবে শিক্ষক হিসেবে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, অগণিত চাকরিজীবীর জীবনেই রয়েছে এমন অনেক অপ্রাপ্তি। তারপরও তারা নানা কারণে সেই চাকরিটাই করেন ও সেই চাকরির নির্ধারিত দায়-দায়িত্বও পালন করেন। তাই আমরা যারা যে কোনো কারণেই হোক শিক্ষকতায় এসেছি এবং রয়েছি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা বা অনীহা দেখানো অনুচিত বলেই আমি মনে করি।
যিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘শিক্ষকদের বুঝি আর কাজ নাই?’ তাঁর কাছে যদি জানতে চাই, শিক্ষকদের কাজ কী? তার উত্তরে তিনি কী বলবেন আমি জানি না। তবে আমি জানি ও মানি, সত্যিকারের শিক্ষকদের অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্তব্য রয়েছে। যা আর্থিক মানদণ্ডে পরিমাপ করা অসম্ভব।
একজন শিক্ষক যদি আসলেই শিক্ষক হয়ে উঠেন তো তিনি সমাজের, রাষ্ট্রের, বিশ্বের শিক্ষক হয়ে যান। হয়ে যান সবার ছাত্রও। তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিধি সীমাহীন হয়ে যায়। তাঁর নিয়োগপত্র ও কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্ধারিত কর্ম ও সিলেবাস সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পরেও তিনি প্রতিনিয়ত পালন করেন অনেক অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। মানুষের অধিক কল্যাণ চিন্তা করেই সেসব তিনি করেন সেচ্ছায় ও বিনা পারিশ্রমিকে। তখনই তিনি হয়ে উঠেন উত্তম। তখনই তিনি হয়ে উঠেন সর্বজন শ্রদ্বেয়। তখই তিনি হয়ে উঠেন প্রকৃত শিক্ষক।
প্রতিটি মানুষ তার চিন্তার সমান শুদ্ধ, কর্মের সমান উত্তম। যিনি যত শুদ্ধ চিন্তা করবেন, তিনি তত শুদ্ধ মানুষ হবেন এবং যিনি যত উত্তম কর্ম করবেন তিনি তত উত্তম হয়ে উঠবেন। এই শুদ্ধ ও উত্তম তিনি হবেন নিজের বিবেকের কাছে। সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে কী দিলো, আর কী দিলো না, সেই হিসাব এখানে মিলবে না।
একজন শিক্ষার্থীকে ধুমপান না করার উপদেশ দিয়ে, বড়কে মান্য ও ছোটকে স্নেহ করার পরামর্শ দিয়ে, কাউকে আঘাত না করার শিক্ষা দিয়ে, আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার নিয়ম শিখিয়ে দিয়ে, মিথ্যা না বলা ও দুর্নীতি না করার প্রতিজ্ঞা করিয়ে, মানব কল্যাণে নিবেদিত হবার ব্রত দিয়ে, সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে, কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক হবার পথ দেখিয়ে, মনের গভীরে যে পরিতৃপ্তি লাভ করবেন প্রকৃত শিক্ষক, কীভাবে নির্ধারিত হবে তার আর্থিক মূল্য?
একজন শিক্ষকের উপদেশে যদি একজন মানুষও শুদ্ধ হয় তো সেই শিক্ষকের শিক্ষকতা জীবন স্বার্থক। আর কেউ দেখুক বা না দেখুক, তিনি নিজেই দেখবেন তাঁর স্বার্থকতা। একান্তে নিজেই মূল্যায়ন করবেন নিজেকে। সবার অজান্তে লাভ করবেন আত্মপরিতৃপ্তি। অঢেল অর্থ দিয়ে কেনা সম্ভব নয় এই পরিতৃপ্তি। অন্য চাকুরেদের পক্ষেও অর্জন সহজ নয় এই সফলতা। একদল শিক্ষকের সহায়ক ভূমিকায় যদি সমাজ থেকে একটা কুসংস্কার দূরীভূত হয়, একটা বাল্য বিবাহ বন্ধ হয়, একটা মানুষের জীবন রক্ষা পায়, তো পুরো শিক্ষক সমাজ সার্থক।
প্রিয় শিক্ষক, আমরা অধিক ভাগ্যবান যে, আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেক শিক্ষার্থী আছে। আসুন, তাদের মাঝে শুভ চিন্তা প্রোথিত করে, মানব সন্তানকে মানুষ করে, সুস্থ সমাজ রচনা করে, আমরা হয়ে উঠি সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর। মনে রাখুন, নিয়োগপত্র পেলেই শিক্ষক হওয়া যায় না, শিক্ষক হয়ে উঠতে হয় চিন্তায় ও কর্মে।
লেখক: শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।