গল্পটা আত্মহত্যার হলেও হতে পারত! - দৈনিকশিক্ষা

গল্পটা আত্মহত্যার হলেও হতে পারত!

ডা. সুস্মিতা জাফর রুমু |

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে জীবনের পুরো ১২টা বছর সময়ে আমি ছিলাম খুব আলাভোলা টাইপের মানুষ। রেজাল্টের দিক থেকে কখনোই আমার ইচ্ছে ছিল না প্রথম হব, আমার টার্গেট ছিল শুধু এ প্লাস পাওয়া। প্রচণ্ড হাসিখুশি আর আড্ডাবাজ ছিলাম।

এমন কোনো সেকশন নাই যে, ক্লাসের ফাঁকে অথবা টিফিন পিরিয়ডের সময় জম্পেশ আড্ডা দিয়ে আসি নাই। এমন কোনো সেকশন ছিল না, যেখানে আমার কোনো না কোনো বন্ধু ছিল না। তবে অবশ্যই সেই বন্ধুরা খুবই স্পেসিফিক এবং স্পেশাল। অত্যন্ত নীতিবান এবং খানিকটা ভীতু স্বভাবের হওয়ায় শাস্তি পেতে হবে এমন কোনো বড় ধরনের অন্যায় কখনও করিনি। কথায় আছে যে, সঙ্গদোষ বলে একটা কথা আছে।

কলেজে আমি ছিলাম সি সেকশনে এবং আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন দুজন ম্যাডাম। একজন ইংরেজির শিক্ষক আর একজন পদার্থবিজ্ঞান। শিক্ষকদের আমরা ডাকতাম ‘আপা’ বলে এবং এখনও তাই ডাকি। ওই সময় কোথা থেকে কলেজ বাসে নতুন এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে জীবনে প্রথমবারের মতো অ্যাসেম্বলি মিস করি আমি। ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম মাঠে, সেই তথাকথিত বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে করতে আর অ্যাসেম্বলি হচ্ছিল আমাদের সুবিশাল অডিটোরিয়ামে। আচমকা দূর থেকে লক্ষ্য করলাম, অ্যাসেম্বলি শেষে সব মেয়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে লাইন ধরে, আর আমি জানিই না যে, আজ অ্যাসেম্বলি হবে! ওকে বললাম, কী করব? সে বুদ্ধি দিল, লুকিয়ে লাইনে ঢুকে যাও।

আমি জানতাম, কোনো লাভ হবে না। আমাদের ভলান্টিয়াররা ছিল অত্যন্ত দায়িত্বশীল, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মুশফিকা ভলান্টিয়ার হওয়ার পর ক্লাসে সবার আগে আমার ব্যাগ চেক করত এবং তা খুব নিখঁতভাবেই করত, যেন কেউ বলতে না পারে বন্ধু বলে ছেড়ে দিচ্ছে! যদিও জানত, আমার ব্যাগে কিছুই পাওয়া যাবে না।

যাইহোক, আমার দ্বিতীয় ভুলটা ছিল ওই মেয়ের কথা শুনে লাইনে দাঁড়িয়ে যাওয়া। উপর থেকে আমার ক্লাস টিচার পদার্থ বিজ্ঞানের আপার চোখে কিন্তু ততক্ষণে ঠিকই ধরা পড়ে গিয়েছি। আপা দ্রুত নিচে নেমে শুধু আমাকে বললেন, আগামীকাল গার্ডিয়ান নিয়ে আসবে। আমি ড্যাব ড্যাব করে আপার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

অন্য কোনো শাস্তি না। কিন্তু আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল!

আমার শুধু মনে হতে থাকল, আপা আমাকে মারুক, কাটুক, কানে ধরে ওঠবস করাক। তবুও আব্বু-আম্মুকে না ডাকুক। লজ্জায় নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াতে লাগল। কী করব আমি, কোন মুখে আব্বুকে বলব তোমাকে ডেকেছে আমার আপা।

স্কুলের ১০টা বছরে যেখানে স্কুলবাসে যাতায়াত করছি, বাবা-মা কোনোদিন দিতে অথবা নিতে আসতে পারেনি ব্যস্ততার কারণে। কোনো অপরাধের জন্য ডাক পাওয়া তো দূরের কথা- সেখানে গুডি গুডি গার্ল আমি, আজ এই ১১ বছর পর অ্যাসেম্বলিতে একটামাত্র দিন না দাঁড়ানোর জন্য কীভাবে আমার আব্বু-আম্মুর কাছে কৈফিয়ত দেব! এর চেয়ে অন্য যে কোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজি। তখন এমনই অনুভূতি হচ্ছিল আমার কিশোর মনে।

সারা রাত ঘুমালাম না। ১১ ডিসেম্বর ২০০৫ আমার জন্মদিন ছিল সেই সকালটায়! আর সেই নিজের জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনটাতেই খুব ভোরবেলা দুরু দুরু বক্ষে আম্মুকে জানালাম আজ যেতেই হবে স্কুলে তোমাদের।

দুজনের চোখেই ভয়ের ছাপ, প্রবল দুশ্চিন্তার ছাপ। কী আবার করল তাদের এই শান্ত-ভদ্র মেয়ে? আম্মুর অফিস থেকে ছুটি পেল না, অগত্যা আব্বুকেই যেতে হলো। প্রচণ্ড ভয়ে ছিলাম আমার অসহায় বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে। না জানি কী বলে আপা আমার বাবাকে অপমান করবেন! উনি কী আব্বুকে বকা দেয়ার পর আমাকে টিসি দেবেন? আমার আব্বু কী মান-সম্মান নিয়ে সমাজে থাকতে পারবে আর আজকের পর থেকে? এ রকম বিভিন্ন আশঙ্কায় অস্থির হয়ে গেল আমার মন।

এর মাঝে আপা এলেন কলেজে। আপা আমাকে একটু দরজার কোণায় গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। আর আব্বুকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। বুঝলাম, তাহলে নিশচয়ই দফায় দফায় অপমান হবে। তীব্র আতংকে জর্জরিত আমি। কারণ এর আগে কোনোদিন কোনো অপরাধ করিনি স্কুলে, জানি না তাই এ ধরনের অপরাধে শাস্তি কী হতে পারে? কতক্ষণ ধরে আপা আব্বুকে অপমান করবেন, ভেবে পাচ্ছিলাম না।

ভয়ে ভয়ে দরজা দিয়ে উকি দিলাম ভেতরে, আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম। আসলে হতভম্ব হয়ে দেখলাম, আব্বু আর আপা হাসতে হাসতে কথা বলছেন! কী বলেছিলেন পুরাটা আমার শোনা হয়নি, শুধু আব্বু যখন বের হচ্ছিলেন রুম থেকে আমার আপা আমাদের পদার্থবিজ্ঞান আপা খুব আন্তরিকভাবে বললেন- জি ভাই, একটু খেয়াল রাখবেন ওর প্রতি। তাহলেই হবে। আপনাকে কষ্ট দিলাম এত দূর থেকে এলেন।

আব্বুও হেসে বলল, জি আপা, অবশ্যই এবং আরও আজব ব্যাপার ছিল এই যে, বাসায় ফিরে ওইদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার করা সেই ভুল নিয়ে না আমার আব্বু কোনো কথা বলেছে- না আমার আম্মু, না আমাদের আপা! মনে হয়েছিল,ব্যাপারটা বেমালুম গায়েব হয়েছিল, যেন ব্যাপারটা ঘটেইনি আদৌ!

আমার এই ঘটনাটা এর আগে আমি কাউকে কখনো বলিনি লজ্জায়, কিন্তু আজ আমার গর্ব হচ্ছে আমার শিক্ষকের জন্য। জানি না, হয়তো সেদিন ঘটনা একদম উলটো কিছু হলেও হতে পারত। কিন্তু হয়নি, আমাদের আপাদের জন্যই হয়নি।

আত্মহত্যা কখনো কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না তা আমি জানি। কিন্তু ওইদিন উলটো ঘটনা ঘটলে আমিই বা কী করে বসতাম সেটাও জানা নেই। সেই ঘটনার ঠিক ১৩ বছর পরে, সেই ডিসেম্বর মাসটাতেই আজ আমারই স্কুলের একজন ছাত্রী ঠিক উলটো রকম ব্যবহারের কারণে আত্মহত্যা করেছে। খুব খারাপ লাগছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। খুব দুঃখজনক।

 

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

 

সৌজন্যে: যুগান্তর

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033650398254395