গাইড-নোট বই, কোচিং প্রতিরোধ্য কী! - দৈনিকশিক্ষা

গাইড-নোট বই, কোচিং প্রতিরোধ্য কী!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এ দেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে, শিক্ষার অভিভাবক হয়ে যাঁরা আসেন, তাঁরা এর উন্নয়নের জন্য পুরনো কথাকে নতুন বর্মে ঢেকে পরিবেশন করেন। কখনো কখনো কঠিন চমকও থাকে তাতে। এতে জনগণ আশান্বিত হয়। তারপর যে লাউ সেই কদু থেকে যায়। জগদ্দল আর সরানো যায় না। শিক্ষা ক্ষেত্রে সেই অনড় হিমাদ্রি হলো কোচিং আর গাইড বই। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

আজকের দিনের কোচিং ব্যবসা নতুন কোনো অভিধা নয়। পুরনোর রূপান্তর মাত্র। একদা রাজরাজড়ারা নিজেদের সন্তানের শিক্ষার বুনিয়াদ পোক্ত করার অভিপ্রায়ে সমকালীন অভিজ্ঞ শিক্ষককে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানাতেন, ওই যে কবিতায় আছে না—‘কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলবি দিল্লির’, তারও অনেক আগে স্বর্গ থেকে দেবসন্তান মর্তে আসত যশস্বী পণ্ডিতের কাছে। কালপরিক্রমায় সেই প্রবণতা সামর্থ্যবানদের ‘দহলিজ’ পর্যন্ত গড়ায়। এখন সর্বগ্রাসী বিবর্তিত রূপ গ্রামগঞ্জে পরিব্যাপ্ত। এ যেন সংক্রামক ব্যাধি। এর মূল কারণ না খুঁজে আমরা শিকড় কেটে কাণ্ডে জলসেচন করছি।

একজন শ্রেণি-শিক্ষকের পক্ষে কয়জন শিক্ষার্থীর দেখভাল করা সম্ভব, সেটা মাথায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করলে প্রাথমিকভাবে গাইড-কোচিংয়ের অক্টোপাস মুক্ত হওয়া যায়, এবংবিধ পরামর্শ অনেকে প্রদান করেন। তবে ‘এহ বাহ্য’। কোনো কোনো কঠোর নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে একটি শিক্ষার্থীও বেশি ভর্তি করা হয় না। প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয় বুঝিয়ে তালিম দেওয়ার কথা বলা হয়। তখন সেখানকার শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ প্রাইভেট পড়ার জন্য প্রাণান্ত হয়। তার সঙ্গে নোট-গাইড তো আছেই। সুতরাং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বড় বিবেচ্য নয়, নয় আর্থিক সুবিধাদানও। শিক্ষক শিক্ষাব্রতী হলে অনেক কিছুই মেলানো যায়। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গলদ এখানেই যে ব্রতী শিক্ষকের বড্ড অভাব। সেখানে ব্রতী শিক্ষকের পরিবর্তে পায়াভারীদের সুযোগ দেওয়া হয়। এঁরা টিপ দিয়ে প্রতিষ্ঠানে ঢোকেন, আবার তেমনি কায়দায় বেরিয়ে যান। শিক্ষাদানের কথা বেমালুম ভুলে যান। এ যেন ব্রতহীন আর পাঁচটি চাকরির মতো। ‘মাস গেল, টাকা এলো’—এখানেই ভাবনা শেষ। শিক্ষকতা যে চাকরি নয় সনিষ্ঠ ব্রত, তা ওই জাতীয় ব্যক্তির মাথায় আসে না। শিক্ষার্থীরা অথৈজলে হাবুডুবু খায়। বাধ্য হয়ে ছোটে কোচিং করতে, গুরুগৃহে যেতে এবং গাইড-নোট কিনতে। এ অবস্থা প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ঊর্ধ্বগামী।

নামে শিক্ষক হলেই মর্যাদা এমনি এসে ধরা দেবে না। প্রকৃত শিক্ষক অভিধার জন্য যথার্থ সাধনার দরকার। বলা হয়ে থাকে, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও। দুর্ভাগ্য, পাঠদানের জন্য যে অনুশীলনের দরকার, বিষয়ের গভীরে প্রবেশের জন্য যে ধৈর্য ও নিষ্ঠার প্রয়োজন, অনেক শিক্ষক সেখানে নেই। অথবা মেধার অভাব আছে। শিক্ষার্থীকে মুখরোচক সনদ পেতেই হবে। তাই সোনার হরিণের পেছনে ছোটে। ধারে-কাছে আশানুরূপ প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না পেলে দূরদূরান্তে পাড়ি জমায়। তাতে প্রকৃত শিক্ষার চেয়ে টাকা কুড়াবার অস্ত্রের জোগাড় বেশি হয়। এ অবস্থা শুধু শহরেই থেমে নেই, গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে গেছে জীবন-মনন ধ্বংসকারী ভাইরাসের মতো। সব শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক পাচ্ছে। গ্রামের মেয়েদের দেওয়া হচ্ছে উপবৃত্তি। সাধারণ মানুষ সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ‘সকলি গরল ভেল’ যাঁরা পড়াবার দায়িত্ব উমেদারি করেন বা অর্থের বিনিময়ে নিয়েছেন, তাঁরা কয়জন প্রকৃত শিক্ষকতার যোগ্যতা রাখেন? ফলে পাস করার জন্য শিক্ষার্থীরা গাইড কিনতে বাধ্য হয়। তা ছাড়া এখন হাটতলা-বটতলায় কোচিং গজিয়ে উঠেছে। শহুরেদের দেখাদেখি গ্রামের ছেলে-মেয়েরা সেই আলেয়ার প্রতি ধাবিত হচ্ছে।

আমাদের কোচিং-গাইড নির্ভরতা একদিনে তৈরি হয়নি। সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে কিছু সমাজসেবক জাতির মূলকে অজান্তে আধমরা করতে যেখানে-সেখানে শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন, আবার উচ্চশিক্ষায় প্রলুব্ধ করে অনার্স-মাস্টার্সও প্রবর্তন করেন। এখানকার বেশির ভাগ বিদ্যাদাতা জীবিকার জন্য আগত। মেধার উৎকর্ষের পরিবর্তে শিক্ষার্থীসহ জাতিকে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছে।

সময় ফুরিয়ে যায়নি। সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজনে শুধু অবকাঠামো নয়, জাতীয় চেতনা উন্নয়ন জরুরি। আর এ কাজে সহায়ক হবেন নিরাসক্ত, দৃঢ়সংকল্প মেধাবী তরুণ।

পন্থা যতই উদ্ভাবিত হোক না কেন অথবা বিদেশ থেকে ধার করে আনা হোক, যাঁদের হাতে শেখানোর ভার থাকবে তাঁরা যদি দুর্বল হন, তবে দেশি-বিদেশি মকরধ্বজ দিয়ে কাজ হবে না। অথচ বেচারা শিক্ষার চারপাশে তাঁদেরই আনাগোনা।

জাতীয় উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক মেধাবী মানুষের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, যা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়ক হয়। সবাইকে অনার্স-মাস্টার্স পড়ে বিদ্যার্ণব হতে হবে তা নয়। উন্নত দেশগুলোতেও এর নজির মিলবে না।

আমরা বলে আসছি, সমাজে আর পাঁচটি কর্মকাণ্ডের মতো শিক্ষাকেও পরিকল্পিত হতে হবে। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু তা কত দূর পর্যন্ত, কারা গ্রহণ করবে। একটা পর্যায় পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়ে হলেও শিক্ষা নিশ্চিত করার পর ওপরে আর নয়। মেধাবীদের জন্য উচ্চশিক্ষা উন্মুক্ত থাকবে। তারা সরকারি সহায়তা পাবে। যেনতেন করে সনদ সংগ্রহ করে টাকার জোরে উচ্চশিক্ষার দ্বারস্থ হলে জাতি বিড়ম্বিত হবে। অবস্থার উন্নতি বিলম্বিত হতেই থাকবে। ভিন্ন পন্থায় নোট-গাইড আর কোচিংয়ের সুড়ঙ্গ তৈরি হবে। সংশ্লিষ্ট সবার বোঝা উচিত।

পরিকল্পিত শিক্ষা, শিক্ষা সংকোচন নয়। এসবের মূলে রয়েছে মেধাবী সুশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ। তারপর প্রয়োজনে কোচিং-নোট-গাইড বন্ধের চিন্তাভাবনা জাতিকে স্বস্তি দেবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : গোলাম কবির, সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047740936279297