সুপ্রাচীনকাল থেকেই আমরা গুজব নামক সংস্কৃতিকে লালনপালন করে আসছি—যা থেকে কালের পরিক্রমায় এখনো আমরা গুজব থেকে বেড়িয়ে আসতে পারিনি। সমগ্র দেশ যখন উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে হু হু করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ঠিক তখনই একটি সুযোগসন্ধানী কুচক্রী মহল নিজস্ব স্বার্থান্বেষণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন থেকে গুজব নামক অপসংস্কৃতির সর্বনাশা ঢেউয়ে ভাসছি আমরা। গুজব হচ্ছে এমন একটি বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ভুল তথ্য ও অসংগত তথ্য এই দুই বোঝাতে ব্যবহূত হয় গুজব শব্দটি। মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যকে উপস্থাপন বা প্রচার গুজবেরই অংশ। সমপ্রতি পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মুণ্ডু লাগবে এমন গুজব দেশের জন্য নেতিবাচক। কেননা গত কয়েক দিনে দেশের নয় জেলায় এই গুজবের বশবর্তী হয়ে গণপিটুনিতে ছয় জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে বাইশ জন। যা চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত। গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা আইন বহির্ভূত ও নীতি-নৈতিকতা বর্জিত কাজ। আর এমন অমানবিক, পাশবিক কাজে আমরা কেন জড়িয়ে পড়ছি সেই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি। বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন মো. আহসান হাবিব।
নীল আর্মস্ট্রং ১৯৬৯ সালে চাঁদে গিয়েছেন—তাঁর মুখ চাঁদে কখনো দেখা গেল না অথচ এদেশের ধর্মীয় নেতার মুখ চাঁদে দেখা যায় এমন গুজবও আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। ঐ গুজবেও প্রাণ হারিয়েছিল অনেক মানুষ। আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্য অর্জন হয়েছে—এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু মুষ্ঠিমেয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থান্বেষণের ফলে বর্তমানে ডিজিটাল গুজব বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে আসছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি অংশ গুজব, কুসংস্কারের মতো নীতি বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছি। যা ভাবতে খুবই লজ্জাবোধ হচ্ছে। অনেকের ধারণা দেশের মানুষ ‘মব সাইকোলজি’তে ভুগছে। যার অর্থ হলো—গণপিটুনির মানসিক প্রবণতা।
গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা ফৌজদারি অপরাধ। এটা জেনে অথবা না জেনেই আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে উত্তেজিত জনতা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না তারই জানান দিচ্ছে। আমরা অবগত আছি গত কয়েক দিনে গণপিটুনিতে যারা জীবন হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন তারা সবাই সাধারণ জনগণ। আমাদের ভাবতে হবে এমন গুজবের বলি আমি বা আমরা নিজেরাও তো হতে পারি?
পদ্মা সেতু তৈরিতে প্রয়োজন রড, সিমেন্ট, বালি, ইট, পাথর, সেখানে মানুষের কল্লা দিয়ে কি হবে? আমাদের আতঙ্কিত হলে চলবে না। অভিভাবক হিসেবে শিশুদের প্রতি সতর্কতা অবলম্বন অবশ্যই কাম্য। এখন বর্ষাকাল, কয়েকটি জেলায় বন্যাও হচ্ছে। চারিদিকে শ্রাবণের পানি থই থই করছে। আপনার শিশুসন্তানকে পানি থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন, শিশু পাচারকারীদের থেকে সজাগ থাকুন, যৌন নির্যাতনের হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করুন, স্কুলে আনা-নেওয়ার সময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। পদ্মা সেতুতে শিশুর কল্লা লাগবে এমন ভ্রান্ত ব্যাপারে কর্ণপাত না করে শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠনের প্রতি যত্নশীল হউন।
পৃথিবীর অনেক দেশে গুজব, অপপ্রচার রোধে উচ্চ গবেষণার ব্যবস্থা আছে—যা আমাদের দেশে চালু হওয়াও জরুরি। রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের মোক্ষম হাতিয়ার গুজব। যা জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের দণ্ডবিধি জানতে হবে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাভোগ। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের গুজবের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক। সভা, সমাবেশ, শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা, বিশেষ করে নাটক, সিনেমার মাধ্যমে মানুষের কাছে গুজবের অমানবিক ফলাফলের দিক উন্মোচিত করতে হবে। স্কুলজীবনে কবি শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় পড়েছিলাম-
‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।’ এই চিলই হলো বর্তমানে গুজব। অসত্য, বানোয়াট গুজবকে সমর্থন না করে আমাদের চৈতন্যোদয় হোক এমন প্রত্যাশাই করি।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।