বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জাতির মস্তিষ্ক, যা জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করে। শাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান সৃষ্টি, আহরণ ও বিতরণ কেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য হলো বিচিত্র বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে সুশিক্ষিত, সুনাগরিক ও নৈতিকতাসম্পন্ন একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা, যারা সমাজ, জাতি বা দেশের ক্রান্তিলগ্নে দিকনির্দেশনা দেবেন। যে কোনো দেশে গুণগত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূমিকা যাচাই করার জন্য ফি বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করে। সোমবার (১৪ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, কিছুদিন আগে লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ২০২০ সালের জন্য বিশ্বিবদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। মূলত শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা, সুনাম এবং আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতাসহ প্রায় ১৩টি ক্যাটাগরির ওপর ভিত্তি করে এই র্যাংকিং প্রকাশ করেছে, যেখানে বিশ্বের ৯২টি দেশের ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয় স্থান দেওয়া হয়েছে। এই ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই আছে। তবে এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১০০০ প্লাস অর্থাত্ বিশ্বের ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন বিশ্বের ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই? এই নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে; হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেখানে অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিংয়ে ওপরে যায় আমরা সেখানে রকেটের গতিতে নিচের দিকে নামছি। টাইমস হাইয়ার এডুকেশন রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পরিবেশের ক্ষেত্রে পেয়েছিল ২০ দশমিক ৪। কিন্তু ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৬-তে। অর্থাত্ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতি হয় নিচের দিকে, ওপরের দিকে নয়!
এখন প্রশ্ন হলো,আমাদের বিশ্ববিদ্যায়লগুলোর এমন অবনতি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে যে কয়টি বিষয় সামনে আসে তা হলো শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতা, গবেষণার প্রতি অবহেলা, মেধা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে না পারা ইত্যাদি।
প্রথমত, শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। আর সে মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর হলেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের কর্ণধার ভাবা হয়। সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবেন, এটিই শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু এখন শিক্ষক মহোদয়েরা শিক্ষকতার চেয়ে রাজনীতিতে পদপদবিকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক পদমর্যাদার মাধ্যমে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপক অভিযোগ উঠছে প্রতিনিয়ত। শিক্ষক হলো জাতিগঠনের কারিগর, এই কারিগরেরাই যদি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অবৈধভাবে এবং অনৈতিকভাবে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আসেন, তাহলে তারা কতটুকু নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী কিংবা জাতি তৈরি করবে—এটাই এখন বড়ো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার প্রতি অনীহাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।
সর্বোপরি, বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসে গড়ে তুলতে হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর নজর দিতে হবে। দলাদলির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অপরাজনীতি বন্ধ, শালীনভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বচ্ছভাবে শিক্ষক নিয়োগ, আবাসন সংকটমুক্ত এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত হবে। পরিশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সেই অমর উক্তি, ‘একটি দেশ ভালো হয়, যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’
সাদ্দাম হোসেন : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।