কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'বঙ্গমাতা' কবিতায় লিখেছেন-"সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধা জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করোনি।
কবি গুরুর এই পঙ্ক্তি থেকে সহজে অনুমেয় যে, আমরা সকলে বাঙালি এবং দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখবিশিষ্ট দেহধারী মানুষ হলেও যোগ্য মানুষ নয়। একজন মানুষকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারে কেবল শিক্ষা।
সাধারণত আমরা অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুটো উপায়ে শিক্ষা অর্জন করে থাকি। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হলো, পরিবার এবং সমাজ থেকে আমরা যা শিখি অর্থাৎ সভ্যতা, ভদ্রতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, নৈতিকতা, অপারের প্রতি শ্রদ্ধা, পরোপকার, উদার মানসিকতা, সামাজিকীকরণ ইত্যাদি।
অপর দিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা যে পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন করি সেটা। প্রকৃত মানুষ হতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমান গুরুত্ব বহন করে। তবে আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নেই। সাথে সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হতে হবে গুণগত মানসম্পন্ন। শিক্ষার মান সঠিক না হলে শিক্ষার্থীরা সনদ অর্জন করবে ঠিকই, কিন্তু সে শিক্ষা হবে ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’র মত অর্থাৎ অন্তঃসারশূন্য।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরে আমরা শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়াতে পারলেও মান বাড়াতে ব্যর্থ। ২৬ লাখ শিক্ষিত বেকারকে দেখলে যার প্রমাণ আমরা পাই। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার শিক্ষার মান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক স্তরে সেকায়েপ (সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যাকসেস অ্যান্ড ইনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট) প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যান্ত ধাপে ধাপে দেশের প্রত্যন্ত ও দরিদ্র অঞ্চলের দুই হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ে ছয় হাজার মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ছিল।যাদের পদবি ছিল অ্যাডিশনাল ক্লাস টিচার (এসিটি) অর্থাৎ অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক। এই অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষকের মত পাঠদানের পাশাপাশি বিদ্যালয় শুরুর পূর্বে প্রতিমাসে ১৬টি অতিরিক্ত ক্লাস নিত। যে ক্লাসের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীরা তাদের দূবোর্ধ্য বিষয় গুলো সহজে বুঝে নিতে পারত। ফলে শিক্ষার্থীদের আলাদা করে প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সেকায়েপ কর্তৃক নিয়োগকৃত শিক্ষকরা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। যার চিত্র আমরা সেকায়েপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই। এই সকল শিক্ষকরা কেবল শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে নয়; শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক উৎকর্ষ সাধন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্ঠি, বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিক্ষার্থী ঝরে যাওয়া রোধে কাজ করেছে।
আমরা জানি, সেকায়েপ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর। সে থেকে প্রকল্পভুক্ত শিক্ষকরা প্রকল্প এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মৌখিক আশ্বাসে বিনা বেতনে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারা এই সকল শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে প্রকল্প সমাপ্তির দীর্ঘ আট মাস পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ২৮ আগস্ট মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য সম্ভাব্য শর্ত এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সংশ্লেষের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠাতে বলেছে।
শিক্ষার মান ধরে রাখতে সেকায়েপ শিক্ষকদের স্থায়ী করার বিকল্প নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্র কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রথমত, মন্ত্রণালয় প্রকল্পভুক্ত সফল শিক্ষকদের রাখা না রাখার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে যদি আট মাস সময় নেয়, তবে তাদের স্থায়ী করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কত দিন লাগাবে? এ ব্যাপারে একটি চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন, কেউ যদি চায় তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরকে এমপিওভুক্তির প্রস্তাব পাঠাতে বলার পর ইতোমধ্যে এক মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী কোনো কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরকে আর্থিক সংশ্লেষের পাশাপাশি সম্ভাব্য শর্ত পাঠাতে বলেছে। কিন্ত এ শর্ত কাদের জন্য প্রযোজ্য হবে? প্রকল্প ভুক্ত শিক্ষক নাকি মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কোনো ক্ষেত্রে? তিন বছর শিক্ষকতার পর অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকল্পভুক্ত শিক্ষকদের শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ করে স্থায়ী করা হলে তার মত প্রহসন আর হতে পারে বলে মনে হয় না।
তৃতীয়ত, এসব শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির মাধ্যমে স্থায়ী করা হলে আগের মত ১৬টি অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে বিগত তিন বছর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শিক্ষার যে মান অর্জিত হয়েছিল, সেটা কি আমরা ধরে রাখতে পারব? শিক্ষার মান উন্নয়নে অতিরিক্ত ক্লাশের প্রয়োজন রয়েছে।
আমার মনে হয়, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শিক্ষার মান ধরে রাখতে প্রকল্পের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির মাধ্যমে স্থায়ী না করে অতিরিক্ত ক্লাশ রাখা যায়, এমন ব্যবস্থায় স্থায়ী করা যেতে পারে। অথবা সেকায়েপ প্রকল্পের অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকদের অপারেশন ম্যানুয়াল অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রকল্পের ম্যানুয়ালের ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, 'সফল এসিটি (অ্যাডিশনাল ক্লাশ টিচার) মডেল সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সেক্টর ওয়াইড অ্যাপ্রোচ প্রোগ্রামে প্রতিফলিত হবে।
আমরা জানি মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য সেক্টর ওয়াইড অ্যাপ্রোচ প্রোগ্রাম হিসেবে সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি) নামে একটি প্রোগ্রাম চালুর সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে তার অনুমোদন দিয়েছেন। এসইডিপিতে অতিরিক্ত শ্রেণিশিক্ষক নামে একটি কম্পোনেন্ট রয়েছে। সেকায়েপের অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকদের এসইডিপির অধীনে কাজের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। তাহলে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার কোনো অসুবিধা থাকবে না।
আগামী কয়েক বছর অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক কর্মসূচি চালু থাকলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শিক্ষার যে মান অর্জিত হয়েছিল, সেটা টেকসই হবে বলে মনে করি। পাশাপাশি প্রোগ্রাম বা প্রকল্পে কর্মরত কর্মচারীদের চাকরির একটা নিশ্চয়তা থাকা উচিত, না হলে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তরা স্থায়ী কাজের সুযোগ পেয়ে অন্যত্র চলে গেলে কাম্য চাহিদা পূরণে ব্যাঘাত ঘটবে। সেই সাথে শিক্ষার মান উন্নয়নে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক কর্মসূচি কেবল কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে গুণগত শিক্ষা অর্জন করে আমাদের শিক্ষার্থীরা বাঙালির পাশাপাশি যোগ্য মানুষে পরিণত হবে।
লেখক : শিক্ষানুরাগী, কেশবপুর, যশোর।