রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ১৫ হাজার। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য গ্রন্থাগারে বই আছে মাত্র এক হাজার ৮০০। সেই হিসাবে প্রতি আটজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে বই রয়েছে। যদিও গ্রন্থাগারে ৪০০ সাময়িকীও আছে। তবে বইয়ের সংখ্যা যাই থাকুক না কেন বসার জন্য আছে মাত্র দুটি টেবিল ও চারটি বেঞ্চ। সেখানে বসতে পারেন বড়জোর ২০ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ গ্রন্থাগারে প্রতি ৭৫০ শিক্ষার্থীর জন্য আছে একটি করে আসন। শনিবার (৩১ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন ও মাসুদ রানা।
ওই কলেজে সমস্যা জানতে গত মাসে সরেজমিনে গেলে গ্রন্থাগারের দুরবস্থা দেখা যায়। গ্রন্থাগারের সামনেই পাওয়া যায় বাংলা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল মান্নানকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রন্থাগারে প্রয়োজনীয় বই তেমন একটা পাওয়া যায় না। কলেজ কর্তৃপক্ষেরও এ ব্যাপারে নজর নেই। এর পরও যে বই আছে তা নিতে গেলে টালবাহানা করে। কিন্তু ছাত্রলীগের কেউ গেলে ঠিকই বই দিয়ে দেয়া হয়।’
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটিতে শ্রেণিকক্ষেরও প্রচণ্ড সংকট। মাত্র ২৬টি শ্রেণিকক্ষে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদান করানো হয়। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত পাঠদান করানো হয় এই কলেজে। ৮২ জন শিক্ষক থাকলেও শ্রেণিকক্ষ না থাকায় অনেক শিক্ষকই ঠিকমতো ক্লাস নিতে পারেন না। এক বর্ষের ক্লাস চলাকালে অন্য বর্ষের শিক্ষার্থীদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাত কলেজের মতো এই কলেজেও সেশনজট চরমে। অনার্স ও মাস্টার্সে মোট পাঁচটি ব্যাচ থাকার কথা থাকলেও আছে ৯টি। প্রায় প্রতিটি বর্ষেই ‘ওল্ড’ এবং ‘নিউ’ ব্যাচ রয়েছে।
ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের নির্দিষ্ট কোনো ক্লাস রুম নেই। যখন যেটা ফাঁকা পাওয়া যায় সেখানে ক্লাস হয়। আর মাঝেমধ্যে দুই বিভাগের এক রুমে ক্লাস পড়ে গেলে আমাদের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।’
গত ২৪ জুন অ্যাকাউন্টিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. সাকিব ক্লাস করার জন্য শ্রেণিকক্ষের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রথম ক্লাস ছিল সকাল সোয়া ৯টায়। কিন্তু শিক্ষক না আসায় ক্লাসটি হয়নি। তাই পরবর্তী ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘এই কলেজে ভর্তি হয়ে জীবনের অর্ধেক শেষ। এখানে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো আসা-যাওয়া করে। ৯টায় ক্লাসের কথা বলা হলেও ১১টায়ও সেই ক্লাস হয় না। আবার কোনো বিভাগের পরীক্ষা থাকলে শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে অন্য বিভাগের ক্লাস বন্ধ থাকে।’
কলেজ ক্যাম্পাসে ছোট্ট খেলার মাঠ থাকলেও সেখানে মূলত শিক্ষকদের গাড়ি পার্কিং করা হয়। গত ২৪ জুন খেলার মাঠে একটি সরকারি গাড়িসহ মোট ১৫টি গাড়ি পার্ক করে রাখতে দেখা যায়। কোনো রকমে গাড়ির ফাঁক দিয়ে শিক্ষার্থীরা চলাফেরা করছিল। নাম প্রকাশ না করে একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে বসার মতো কোনো জায়গা নেই। হাঁটাচলার জন্য যা একটু আছে, সেখানে গাড়ি রেখে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন কার কাছে এই সমস্যার কথা বলব! শিক্ষকরাই তো খেলার মাঠে গাড়ি পার্ক করেছেন।’
বার্ষিক স্বাস্থ্যসেবার নামে ২০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হলেও শিক্ষার্থীরা সেভাবে চিকিৎসাসেবা পায় না বলে অভিযোগ করে কয়েকজন শিক্ষার্থী। চিকিৎসাকেন্দ্রে শুধু ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়, কোনো ওষুধ দেয়া হয় না। এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘সপ্তাহে তিন দিন একজন এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক আসেন। তবে তিনি কোনো দিনই সময়মতো আসেন না।’
কলেজে সরকারি দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল মো. সোহেল রানাকে সভাপতি করে এবং আবদুল ওয়াদুদ খান শুভকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে কমিটি করা হয়েছিল। গত ২৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে ওই কমিটির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
কলেজ ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল আমিন বলেন, ‘আমরা চাই স্থগিত কমিটি বিলুপ্ত করে ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন কমিটি দেয়া হোক। যারা সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়াবে, তারাই যেন কমিটিতে পদ পায়।’
সর্বশেষ কবে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছিল সে বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। তবে তাদের তথ্য মতে, নব্বইয়ের দশকের পরে আর নির্বাচন হয়নি। কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গাজি সারোয়ার বাবু দাবি করেন, তিনি সর্বশেষ ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ছাত্রসংসদে ভিপি ছিলেন। কিন্তু ছাত্রসংসদ না থাকলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিকই বার্ষিক ছাত্রসংসদের চাঁদা আদায় করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। এ ছাড়া এই কলেজে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য কোনো পরিবহনব্যবস্থা নেই। এমনকি শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য কোনো ছাত্রাবাসও নেই।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেই আমরা দুই শিফটে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জুলাই মাস থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ক্লাস হবে এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য সকাল সাড়ে ১১টা থেকে ক্লাস শুরু হবে। এ ছাড়া আমাদের কলেজে ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণের প্রজেক্ট পাস হয়েছে। এটি হওয়ার পর ক্লাসরুমের সংকটও দূর হবে। কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে, কিন্তু পাসের হার কমেছে। তবে যত দিন যাবে পাসের হার বাড়বে।’
কলেজের অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘আমাদের গ্রন্থাগারে অনেক বই আছে। আমরা বই আরও বাড়াব। শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগার থেকে বই সংগ্রহ করে পড়ালেখা করে। এমনকি বসেও পড়তে পারে। এ ছাড়া বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের মতো ভালো সংগঠন রয়েছে। আগামী দিনে ডিবেটিং ক্লাব করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’