ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে উচ্চতর সমাজ গবেষণা কেন্দ্রে নিয়মিত বসেন। ৮৩ বছরের ইমেরিটাস অধ্যাপক। না, পোশাকি নয়, বাস্তবেই অধ্যাপক। নিয়মিত আসেন-যান, গবেষণা করেন। লেখেন, বক্তৃতা দেন। ঘরের ভেতরে, ঘরের বাইরে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে ঘর ও বাহির দুটিই তাঁর ক্লাসরুম। ছাত্র কি জনতা, সবাই তাঁর শ্রোতা। অনর্গল লেখক, অনর্গল বক্তা। তবে তাঁর সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য হলো, তাঁর লেখা গদ্য অসাধারণ, তাঁর বক্তৃতাগুলো সুবিন্যস্ত। যাহা তাঁর বক্তৃতা তাহাই তাঁর গদ্য। আর যাহা তাঁর গদ্য তাহাই সুপাঠ্য, যাহা বক্তৃতা তাহাই সুশ্রাব্য। একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাই অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। আমাদের গর্ব। বাঙালির গর্ব। রোববার (২৩ জুন) দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ম. ইনামুল হক।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিক্রমপুরের মানুষ। আড়িয়াল বিলের পাড়ে জলায় জন্ম। একপাশে প্রমত্ত পদ্মা নদী, আরেক পাশে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। সবুজ প্রকৃতির মাঝে বড় হওয়া বাংলার সন্তান। হাজার হাজার বছর ধরে নদীর পলিমাটি দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলার সমতলে রয়েছে তাঁর নাড়ির টান। আবার বড় হয়েছেন বাংলার নানা শহরে। দেখেছেন সারা বাংলা। তাই তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে সারা বাংলার নির্যাসে। তাই একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পুরোপুরি বাঙালি। যদিও ইংরেজির অধ্যাপক তিনি। ইংরেজিও লেখেন, ইংরেজিও বলেন। ইংরেজিতেও তাঁর বক্তৃতা ও লেখনী অনবদ্য। তবু তিনি বাঙালি।
বিলেতের ডিগ্রিধারী এই অধ্যাপক বাঙালি পরিচয় দিতে সদা উন্মুখ। অধ্যাপনাই তাঁর কর্মজীবন। শিক্ষকতাই তাঁর পেশা। এদিক-ওদিক ঘুরে শেষমেশ থিতু হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই তাঁর জীবনের কষ্ট, এখানেই তাঁর আনন্দ। এখানেই তাঁর বিপদ, এখানেই তাঁর মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধে তিনি নাই হয়ে যেতে পারতেন। বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় তাঁর নামও ছিল, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর। হয়তো জনাকুড়ির মধ্যে তাঁকেও আমরা একত্রে স্মরণ করতাম। কিন্তু না, তিনি সেই জনাকুড়ির মধ্যে পড়লেন না। তিনি দৈবক্রমে বেঁচে থাকলেন। তারপর অনেক ঘটনা, জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত। বাস্তব জীবনের সংকট। অন্যদের মতো তিনিও সংসারী হয়েছিলেন, পিতা হয়েছেন, স্বামী হয়েছেন। কিন্তু তারপর যা হয়েছে, তা যেন কারোর না হয়। অকালে স্ত্রী বিয়োগ। বিশাল বেদনা নিয়ে তিনি চলেছেন।
আমরা একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে দেখি, যিনি অসামান্য পিতা, বটবৃক্ষের মতো অভিভাবক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় গুরু। তাঁর সন্তানরা বড় হয়েছে, সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর সংস্পর্শে আসা অসংখ্য মানুষ তাঁর পরামর্শে ধন্য হয়েছে। তাঁর কাছে যে একবার গেছে, সে কখনোই তাঁকে বাতিল করতে পারেনি। একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগোত্তীর্ণ মানুষ। কঠোর মার্ক্সবাদী হয়েও তিনি বিশ্বাসে ও আচরণে কঠোর নন। পুঁজিবাদী সমাজের তীব্র সমালোচক হয়েও তিনি হঠকারী নন। তাই তাঁর দ্বারা যে উপকৃত হয়েছে, সে কখনোই বলতে পারবে না, তিনি কাউকে ক্ষতি করতে পারেন। তাঁর কাছে যে এসেছে, সে কখনোই বলতে পারবে না তিনি কাউকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। হয়তো তিনি সবার কাছে সেভাবে উন্মুক্ত হননি, যেভাবে তাঁকে পেয়ে অনেকে তুষ্ট হতো। সব মানবিক গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনও কাউকে খুশি করার জন্য অভিনয় করেননি। তিনি অভিনয় জানেন না।
একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জীবনে কখনও অভিনয় করেননি। তিনি যা জেনেছেন, যা পড়েছেন এবং তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বাস যা তিনি ধারণ করেছেন, তাই তিনি বলেছেন, তাই তিনি লিখেছেন। তিনি পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত পঙ্কিল সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তিনি সমাজকে পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। তাঁর বিশ্বাসে তিনি কখনও আপস করেননি। বাংলার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাকে ভালোবেসেছেন। বাংলার প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন। তাই আমরা তাঁকে পাই ওসমানী উদ্যান রক্ষার আন্দোলনে, আমরা তাঁকে পাই আড়িয়াল বিল রক্ষার আন্দোলনে। তিনি অকাতরে সহ্য করেছেন এসব আন্দোলনের নিগ্রহ, রাষ্ট্রের তরফ থেকে নেমে আসা অত্যাচার।
একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনন্য। পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত এই অমানবিক জোড়াতালির সমাজকে তাই ভেঙে দেওয়ার সংগ্রামেই নিজেকে লিপ্ত রেখেছেন সার্বক্ষণিকভাবে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সব অভিযাত্রীর তিনি গুরু। সমাজ রূপান্তরের নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নের তিনি কাণ্ডারি। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত 'নতুন দিগন্ত' পত্রিকা অব্যাহতভাবে এক মানবিক সমাজ নির্মাণের দিকনির্দেশনা দিয়ে চলেছে। আমাদের ভরসা, আমাদের সৌভাগ্য যে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, কাজ করে চলেছেন। আজ জন্মদিনে আমি তাঁর প্রতি অপরিমেয় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও দীর্ঘজীবন কামনা করছি।
লেখক: প্রকৌশলী; সাবেক মহাপরিচালক পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা