চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য এবং বিশালত্ব বর্ণনা করে বোঝানোর মতো নয়। পাহাড় এবং টিলাবেষ্টিত, বৃক্ষশোভিত, সবুজের সমারোহে আপ্লুত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মানুষের সৌন্দর্য পিপাসু মন আনন্দে নেচে ওঠে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথটি ১ নং রোড নামে সকলের কাছে পরিচিত। দু’পাশে গ্রামীণ দৃশ্য, সারি সারি বৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত প্রায় এক কিলোমিটারের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবেশ সড়ক-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের শুরুতে আমাদের মন ভাল করে দেয়। শনিবার (১৫ জুন) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ফজলুল হক ।
চট্টগ্রাম শহর থেকে বিশ^বিদ্যালয়ে আসার আরও একটি উপায় হলো- শাটল ট্রেন। এই শাটল ট্রেনে ছাত্রছাত্রীরা আসে। কিন্তু ‘ছাত্র নয়’ এমন যাত্রীও থাকেন। এই শাটলকে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আবেগঘন চিন্তা তাদের লেখায়, ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখা যায়। শাটলকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়। শাটলে প্রেম হয়। শাটল কেন্দ্রিক ভালবাসা হয়। বিরহ বা ব্রেকআপ হয়। শাটলকে নিয়ে গান হয়। এমনকি শাটলকে নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গামী রাস্তা এসে মিশেছে জিরো পয়েন্টে। শাটল এসে থামে বিশ্ববিদ্যালয় রেল স্টেশনে। জিরো পয়েন্ট, রেল স্টেশন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশ গেট, ‘মউর দোয়ান (মামার দোকান)’ এসব পাশাপাশি অবস্থিত।
বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রেল স্টেশন এবং জিরো পয়েন্টকে কেন্দ্র করে সৌন্দর্য বর্ধনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। রেল স্টেশন থেকে যাতে ছাত্রছাত্রীরা সহজে হেঁটে কাটা পাহাড় রোড হয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বরের দিকে, জয় বাংলা ভাস্কর্যে এবং বিজ্ঞান অনুষদের দিকে কিংবা সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের দিকে যেতে পারে, তার জন্য সুদৃশ্য ওয়াকওয়ে নির্মিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এত হৃদয়কাড়া, মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য রয়েছে যে, তার সবকটির বিবরণ দিতে গেলে আমাকে দোকান থেকে কয়েক রিম কাগজ কিনে আনতে হবে।
বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা একজন শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন হল হয়েছে, একাডেমিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। বিভাগের সংখ্যা বেড়েছে, নতুন বিষয় খোলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকে সীমানা প্রাচীর নির্মিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ ভাল আছে। সেশনজট কমেছে। ছাত্র অসন্তোষ কমেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। বিশাল মাপের অনুষ্ঠান সমাবর্তন এবং বিশেষ সমাবর্তন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবান্বিত হয়েছে। ৫০ বছর পূর্তির বিশাল অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছেন। সে এক বিশাল মিলনমেলা।
সরকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসে এক শ’ একর জায়গাজুড়ে হাইটেক পার্ক বানিয়ে দিচ্ছে। এটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি নতুন ডিজিটাল স্পটে পরিণত করবে নিঃসন্দেহে। এর ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিহিত হাটহাজারী উপজেলা নতুন মর্যাদা লাভ করবে। এই হাইটেক পার্ক পুরো চট্টগ্রামকে বদলে দিবে। এখানে বিদেশী বিনিয়োগও আসবে। এখান থেকে রাষ্ট্র রাজস্বও পাবে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চুক্তিও স্বাক্ষর করেছেন।
আমি ও আমার সমসাময়িকরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্রজন্ম। আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ অনেক গৌরবের। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধ- অতীত বিষয় না হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাবনা চিন্তা যেন আমাদের রাষ্ট্রকে আপ্লুত করে এবং নতুন প্রজন্মকে দিক নির্দেশনা দেয়। আমরা খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম, যখন দেখেছি এই বিশ্ববিদ্যালয় পশ্চাৎপদ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের দাপটে ও পদভারে প্রকম্পিত হতো। এদেশের স্বাধীনতার চেতনার স্মারকসমূহ ছিল অবগুণ্ঠনাবৃত। আমাদের এই মনোকষ্ট দূর করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত, নিরিবিলি প্রান্তরে পাহাড়ের পাদদেশে যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াস, যখন দেখি বঙ্গবন্ধু পরিবারের শহীদ সদস্যদের সম্মান দেখানোর প্রচেষ্টা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে আবাসিক হল, যখন দেখি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার কার্যক্রম, যখন দেখি ৫২’র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে অনুপ্রেরণাদায়ী অনুষ্ঠান হয়, বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিনে শিশু-কিশোরদের আর্ট কম্পিটিশন হয় তখন মনে উৎসাহ জাগে, অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সালাম জানাতে ইচ্ছা করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ তো দিতেই হয়।
নেচার জার্নালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ায় সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় গণমাধ্যমে আলোচনায় উঠে এসেছে। আরও কয়েকজন বিদেশী গবেষকের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. ফরিদ যে গবেষণা করেছেন তা সারা বিশ্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়িয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রছাত্রীরা গবেষণায় নানা সাফল্য কাহিনী তৈরি করেছে। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণা খাতে বাজেট বৃদ্ধি করেছে। গবেষণা কর্ম ও গবেষকদের উৎসাহিত করছে। বিশ^বিদ্যালয় গবেষণার জায়গা। এখানে জ্ঞান সৃজন হয়। এখানে বেসিক সায়েন্সের ওপর লেখাপড়া হয়। গবেষণালব্দ জ্ঞান প্রয়োগ করে আমরা প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহার সহজ করতে পারি।
দুই
সেদিন মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কদর বুঝতে পারবে, যে দিন আমরা আরও সামনে এগিয়ে যাব। বিজ্ঞান যে দিন আমাদের চালনা করবে, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কদর ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মান মর্যাদা বুঝতে পারব। আর দশ বছরের মধ্যে আমাদের জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে আসবে। রাস্তায় এবং কর্মক্ষেত্রে রোবট, ড্রোন আমাদের সঙ্গে থাকবে। তখন গবেষকদের আমরা কদর করব।
চট্টগ্রামের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হবে, মান মর্যাদার ও গৌরবের প্রতীক। বিজ্ঞান, সমাজ, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রায়োগিক জ্ঞানের জন্য সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হাত বাড়াতে হবে। তখন আমরা বুঝতে পারব, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কেন পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের তাগিদ দিচ্ছেন।
তিন
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজ নামে একটি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ পরিচালনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য এর উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। স্কুল শাখার সকল শিক্ষকের পদ পূরণ করেছেন। ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। নিজে উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষাবোর্ডের স্বীকৃতিবিহীন অবস্থার অবসান ঘটিয়ে ২০০২ সাল থেকে স্বীকৃতি নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। বিজ্ঞান মেলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা স্কাউটিং করার সূযোগ করে দিয়েছেন। তবে আইনী জটিলতার কারণে কলেজ শাখায় এখনও সকল পদে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষকের সঙ্কট আছে। উপাচার্য এই সঙ্কট নিরসনে কাজ করছেন।
চার
আজ এবং অতীতের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পরিবর্তন দেখতে পাই। যেমন ধরুন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় চট্টগ্রামের মন্ত্রী আছেন ড. হাসান মাহমুদ, তিনি কৃতী ছাত্র, বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক কৃতী শিক্ষক দক্ষ বক্তা, তিনি একজন নামকরা আইনজীবীর সন্তান। মন্ত্রিসভায় আছেন মহিবুল হাসান চৌধুরী তিনি বিদেশে লেখাপড়া করেছেন, চৌকস ব্যক্তিত্ব, চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান। বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সন্তান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ মন্ত্রিসভায় আছেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। চট্টগ্রামের এমপিদের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে বুঝতে হবে দেশের সকল ক্ষেত্রে মানুষের শিক্ষা ও সচেতনতার মান বেড়েছে। সরকারে অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব আছেন। উনারা জ্ঞানী এবং কর্মপটু। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, তারাই জ্ঞানী গুণী, আমলা মন্ত্রী বানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়, তখন দেখা দেয় উপাচার্য পদে নিয়োগ পাওয়ার তদ্বির। এই তদ্বির কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, তা পাঠক সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পান এবং বুঝতে পারেন। শিক্ষিত মানুষের কাজ হলো একে অপরকে সম্মান করা, ছোট করা নয়। এখন সবাই সব কিছু বোঝে। দেশের অধিকাংশ মানুষের বড় একটি অংশ অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উঁচু মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয় তারা বোঝেন না, এখন সেদিন নেই। এখন সব মানুষের কাছে সব রকম তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে।
পাঁচ
আমার দুটি প্রস্তাব আছে : ১. একজন প্রফেশনাল যেন পলিটিক্যাল সাপোর্টের ওপর নির্ভর না করে, নিজের দক্ষতার ওপর আশা ভরসা করেন।
২. নিজে নিজের প্রোফাইল তুলে ধরে বলুন, আপনি যোগ্য ব্যক্তি। অন্যের চরিত্র হনন করে নিজেকে বড় করার চেষ্টা না করাই মঙ্গল। যোগ্য ব্যক্তিত্বকে অসম্মান করে কেউ সম্মানিত হতে পারেন না। বরেণ্য সাহিত্যিক আবুল ফজলকে বঙ্গবন্ধু ডেকে এনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করেছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, তদ্বিরকে ‘না’ বলুন। তদ্বিরকারীকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া না হয়। জ্ঞান ও দক্ষতা যাচাই করুন। মানদন্ড বিচার করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য এবং তা হতে হবে সর্বক্ষেত্রে। এমন হলে এদেশের শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নয়, কোন সংস্থারই অগ্রগতি ঠেকানোর সাধ্য থাকবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ